দেখা

দেখা আর অদেখার মাঝখানে যে সূক্ষ্ম উর্ণনাভ জালটি রচিত হয়, সেটি হঠাৎ ছিঁড়ে গেলে কেমন হয়? ওর ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে দুপুরে আলো, ছায়াছায়া আলোআঁধারীর খেলা l এমন হয় হঠাৎই l মন ভালো করা এমন কত কী যে ঘটে যায় … আর তখনই এক নির্বেদ, ভালোলাগার স্বপ্নে নিরন্তর ভেসে চলা শুরু হয় আবারও l যেন কখনও কিছু হারায়নি, সব ছিল দিনের আলোর গভীরতায়, চোখ মেলে দেখার ছিল অপেক্ষা … আবার সেই সবপেয়েছির আশ্বাস, আবার সেই নিবিড় পুলক লাগানো ভালোলাগায় ভেসে যায় মন … তোমার হাত নেড়ে চলে যাবার মাঝে থাকে না রিক্ততা, সব হারানোর দীর্ঘশ্বাস, থাকে আবার আসার অঙ্গীকার, আবার আবার আবার …. ভেসে চলা বারবার!!

আনন্দময়ী

ভবতারিণী দেবীর মন্দির চত্ত্বরে একবার গিয়ে পৌঁছতে পারলে হয় l দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে আসা যেন আমার বহুদিনের হারিয়ে ফেলা বাপের বাড়িতে যাওয়া l মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করার সারিতে অপেক্ষমানা, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি মন্দিরের ভাস্কর্য l কতদিন ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই সৌধ l এ সব পথ দিয়ে হেঁটে গেছেন শ্রী শ্রী ঠাকুর, শ্রী মা আর তেনাদের পার্ষদবৃন্দ l এ সব ভাবতেই প্রাণ আটুপাটু করে ওঠে l এক মনে বিড়বিড়াই, মা গো সবার মঙ্গল করো মা, শুদ্ধাভক্তি দাও মা, অহেতুকী ভক্তি দাও, রাগা ভক্তি, প্রেমা ভক্তি দাও মা গো l গায়ে কদম্বফুল ফুটে ওঠে, পিঠ বেয়ে শিরশিরে অনুভূতি … অল্প জানা আমি, মনে করি ওই বুঝি কুণ্ডলিনী জাগরণ l তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ওই নাটমন্দিরের চূড়ায় মায়ের মন্দিরের দিকে তাকিয়ে নীল মহাদেব, বুঝি বা মায়ের মন্দির পাহারা দিচ্ছেন l তাঁর পাশে হনুমান মূর্তি হুপ করে বসে পরম বিক্রমে আগলে রয়েছেন মা ভবতারিণী দেবীকে l ১৮৫৫ সালে স্থাপিত হয়েছিল এই মন্দির শ্রীমতি রাসমণি দেবীর পৃষ্ঠপোষকতায়! কবেকার সে কথা l তিনিও মায়ের বড়ো সাধিকা ছিলেন কিনা, তাই বড়ো প্রেমে, বড়ো সমাদরে এই আনন্দমূর্তি স্থাপিত হয়েছিল এই দেবাঙ্গনে l নবরত্ন শৈলীর এই মন্দিরখানির নয়টি চূড়া আকাশভেদী l সেই চূড়ায় কত পারাবতের চিরকালীন বিচরণ l শান্তির দূত এই পাখিগুলি যেন এখানে শান্তির, আনন্দের পরিচায়ক l হাতে পুজোর ডালায় মায়ের জন্যে ফুল, মিষ্টি, আলতা সিঁদুর l মায়ের কাছে আসা, অল্প কিছু আনতেই হয়, সঙ্গে একটি শুদ্ধ মন, শুদ্ধ ভক্তি, চোখের জল l মা অন্তর্যামী, সব বোঝেন, সব দেখেন l আমি মাথা ঘুরিয়ে ওপরে, এ পাশে ও পাশের দেউড়িতে সব দেখি l মানুষের কত আনন্দ মায়ের পায়ের কাছে, দেখে দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় l সবার সঙ্গে মায়ের দরজায় পৌঁছে যাই l ওমা, আজ যে মায়ের একটি কচি মেয়ের রূপ গো l কি মিষ্টি, কি মিষ্টি l গোলাপী রঙা শাড়িতে এখনই বুঝি মল ঝম ঝম মা আমার সিঁড়ি বেয়ে নেমে মন্দির চূড়ায় গিয়ে উঠবে l মাকে গাল ধরে আদর করতে সাধ যায়, মাকে কোলে বসে বেশ করে গপ্পো করতে মন চায়, মাকে শ্রী শ্রী ঠাকুরের মতো করে বলি, ওরে দস্যি মেয়ে, ছুটিসনি রে মা, পড়ে যাবি এখনই l মায়ের গলার মিনা করা ললন্তিকা ঝিকিয়ে ওঠে, মায়ের পানজেব চুটকি মানতাসা, বাজু কথা বলে ওঠে ওই l আমি দরবিগলিত চোখে মা মা করে ডেকে সারা হই l মায়ের মন্দিরে যাঁরা প্রহরী আমাকে চেনে বোধহয় l বলে, মা, তুমি দিকটিতে সরে দাঁড়াও, তাহলে ভালো দেখতে পাবে, অন্য সকলকে দেখতে দাও l সত্যি ঐখান থেকে দেখা আরও যেন ভালো হয় l কতক্ষণ হাঁ করে মায়ের ওই উর্যাশক্তি হৃদয় ভরে গ্রহণ করতে করতে, সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি সঙ্গীসাথীদের কাছে l মা বলে ওঠেন, ওরে, আবার আসিস ‘খনে, অনেক কথা বাকি পড়ে আছে যে l তৃতীয় নেত্রে সেই অরূপের আভাস নিয়ে ফিরে আসি আমি l মনে আনন্দ, ‘হংস’ আছে, তাতে চেপে আবার আসতে পারবো মায়ের বাড়ি l

পুনশ্চ – ‘হংস’ সদ্য কেনা সাদা গাড়িখানি, যা শ্রী শ্রী ঠাকুর মায়ের আশীর্বাদে আমাকে নিয়ে চলেছে, বিভিন্ন দেবালয়, দেউল, মন্দিরে l ধন্য হয়ে উঠেছে এই জীবাত্মা l

অপর্ণা আনন্দময়ী

একা

৯২ বছর বয়েসে যখন কৃপাময়ী তাঁর ৯৮ বছরের স্বামীকে হারালেন তখন ছেলে বৌরা তেমন কিছু ভাবেনি এ নিয়ে l এতো বয়েসে সব ছেলে বৌ, মেয়ে জামাই, নাতি নাতনী, মায় পুতি পুতনি রেখে বুড়ো মানুষটা সদ্য দুর্গাষষ্ঠীর দিন স্বর্গারোহন করলেন, এর থেকে ভালো আর কীই বা হতে পারে? যা গেলো, তা গেলো কৃপাময়ীর l সেই পনেরো বছরে বিয়ে হয়ে এসে ঢুকেছিলেন স্বামীর ঘরে, সেই থেকে একসঙ্গে থাকাথাকি l স্বর্গতঃ আনন্দমোহনের একটুআধটু বেড়ানোর শখ ছিল l তাই ক্বচিৎ কখনো স্ত্রী সমভিব্যাহারে আবার কখনো বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেরিয়ে আসতেন l তখন ওই কিছু কিছু দিনের বিরহ আর তা না হলে সবসময়ে জোড়ের পায়রার মতো বকবকম l খাওয়া দাওয়া, গপ্পো গুজব, রেডিও শোনা, রাতে একসঙ্গে শোয়া চিরকাল ধরে l তাই হঠাৎ স্বামীর অভাবে বৃদ্ধা কৃপাময়ী ভয়ঙ্কর রকমের দিশাহারা হয়ে পড়লেন l ছোট বৌ ছেলের ঘরে জায়গা পাবেন না জেনেই, বড়ো বৌমার দ্বারস্থ হলেন l

কিন্তু সমর্থ যখন ছিলেন, তখন এই দিন দেখতে হবে ভাবেননি l তাই সেই সময়ের কিছু কোন্দল, ঝগড়া ঝাঁটি, বড়ো বৌ মনে পুষে রেখেছিলো l এখন সুবিধেমতো সে তার বদলা নিলো l প্রথমেই ‘না’ বলে দিলো সজোরে l বৃদ্ধ ছেলে, মায়ের কথা বুঝেই বললে –

‘মা এখানেই শোন কিছুদিন, পরে শ্রাদ্ধ শান্তি মিটলে পুরোনো খাট সরিয়ে অন্য খাট পেতে দেব না হয় l এখন ক’দিন, মা না হয় শুলেন এখানেই l’

বৌ মনে মনে বেজায় রেগে, “যত্তসব আদিখ্যেতা” বলে রান্নাঘরের দিকে ধাবিতা হলেন l

মা তাঁর বিছানা বালিশ নিয়ে ছেলের ঘরের মেঝেতে শয্যা পাতলেন প্রতি রাতে l

বেশ হলো, আর একা একা লাগে না l ওই তো খাটের উপরে বড়ো ছেলে আর বৌ আছে l জানালা দিয়ে কেমন আলো এসে পড়ে এই ঘরে l মায়ের মন l আহা বাছারা, সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘুমিয়ে গেছে বুঝি l খুক খুক কাশি আসে একটু l মা প্রাণপণে কাশি চাপতে থাকেন l কিন্তু বৃদ্ধবয়সের কফ কিনা, তাই রাতবিরেতে জাঁকিয়ে আসে l ঘঙ ঘঙ করে কাশেন মা l বড়ো বৌ উল্টো দিকে ফিরে বলে -“জ্বালিয়ে মারলে দেখছি, সারাদিনের পর একটু ঘুমোতেও দেয় না l”

ছেলে উঠে পড়ে, মাকে জল দিয়ে শান্ত করে l কাশি কমলে মা ঘুমিয়ে পড়েন ক্লান্ত হয়ে l ছেলে বিছানায় গিয়ে শোয় l পরদিন মা ভয়ে ভয়ে আছেন l যদি কাশি বাড়ে l এখন তো শ্রাদ্ধশান্তি চুকেবুকে গেছে l বড়ো বৌ রাতের বেলায় ঠিক ফতেয়া জারী করে, “মা ঐঘরে শোন আজ থেকে l”

মা কি করেন l একা একা ঘরে শুয়ে থাকেন মা l ঘুম আসেনা বলে ঘুমের বড়ি বরাদ্দ হয় মায়ের l সেই বড়ি খান বলে অনেক সময়ে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে বিরক্তির পাত্রী হয়ে ওঠেন l

মনের কষ্ট কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন না কেন এই কষ্ট l তাই মাঝে মাঝে বলে ফেলেন – “বড়ো একা লাগে গো, বড়ো একা লাগে l”

বড়ো বৌমা ক্রূর হাসি হেসে একদিন বলে – “দাঁড়ান মা, সবুর করেন, পাত্র দেখি l”

মা বোঝেন না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন l ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় l

ছেলেদের আর কিইবা করার থাকে l

মা শুয়ে শুয়ে নির্ঘুম রাতে প্রার্থনা করেন l ওদের ভালো রেখো ঠাকুর, আমাকে ওঁর কাছে নিয়ে চলো, আর একা থাকতে পারি না l”

অপর্ণা গাঙ্গুলী

কষ্ট

আজ রান্নাঘরের বাইরের জানালাগুলো খোলা হয়ে গেলো l পুরোনো বাড়ি, বুড়ির বাড়ির মতোই আঠা দিয়ে চেটে, ঠুকঠুক মেরামত করে সেরেসুরে রাখা হয় l বাইরের জানালা ভেঙে ঝুলছিলো, ঝড় এসে ভেঙে পড়ে গেলে একাকার কান্ড ঘটতে পায়ে, তাই ওদের খুলে দিয়ে তুলে রাখা হলো l ভেতরের দিকে কাঁচের জানালা লাগানো হয়েছে বাড়ি মেরামতের সময়ে l তাই অসুবিধে নেই l দুঃখের কথা একটাই l ওই বাইরের জানালাটাতে যে কাকটা এসে সারা সকাল বসে অপেক্ষা করতো কখন রান্নাঘরের জানালার বাইরে সে একটু খেতে পাবে l সারা সকাল বসে বসে আমাকে রান্নাঘরে দেখতে পেলেই সে কুক কুক করে তার কাকীয় ভাষায় কি আর্জি জানাতো সে আর আমিই যে শুধু জানি l তাই কষ্ট পেলাম l দুপুরে রান্নাঘরের জানলার বাইরে খেতে দিতেই সে এলো যদিও, তবুও কেমন কষ্ট হলো l তার এতদিনের অবস্থানে ছেদ পড়লো … এটা ভেবে l কষ্ট হয় l

ফেসবুকে একটা ছবি খুব ভাইরাল হয়েছে আজ l একটি ট্যাক্সি ড্রাইভার একটি রাস্তার বাচ্চার মুখে জল ঢেলে দিচ্ছে l গরম পড়েছে, বাচ্চাটা জল চাওয়ায় সেই মানুষটি তাকে জল দিচ্ছে l এ তো অতি স্বাভাবিক চিত্র l এতে আশ্চর্যের কী আছে l এ ছবি দেখে আমি অবাক হইনি l যদি দেখতাম, কেউ কারো মুখ থেকে জল বা গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে, অবাক হতাম তখনই l ঠিক তখনি হয়তো সেই ছবিটা ভাইরাল হতে পারতো, নৃশংসতার নজির হিসেবে l আজকাল মানুষ মানুষকে জল দেবে, তার জন্যেও বাহবা দিতে হয় … এ’সব ভেবে বড়ো কষ্ট হয় l

নিচের ছবিটি দেখুন, ঠিক এই উত্তরটিই বাঞ্চনীয় ছিল l সাবাশ, বড়ো আরাম পেলাম …

একটা ফলন্ত সজনে গাছ মিছিমিছি কাটা হলো l ঠিক মিছিমিছিও নয়, এর জন্যে লোকজন অবশ্যই যুক্তি খাড়া করবেন l যে জমিতে বাড়ি তোলা হবে সেখানে অমনি একটা লম্বা ঢ্যাঙা সজনে গাছ বুঝি এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকবে হাঁ করে? এ কেমন কথা l অগত্যা, গাছ কাটা গেলো l এমন করেই কাটা যায় কত কত গাছ শুধুমাত্র নগরায়নের জন্যে l আর তার ফলে, গরম বাড়ে, আরো গরম বাড়ে, আরো আরো গরম বাড়ে আর ? বাড়ে কষ্ট … খুব কষ্ট l

এইসব দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সুখ এসে জানান দিয়ে যায়, জীবনটা সুন্দর l Du কলম থেকে সুদেষ্ণা দির দেওয়া কুচি গাছটা বড়ো প্রিয় আমার l কিছুদিন যাবৎ যেন নেতিয়ে পড়েছিল l সামান্য শুশ্রুষা করতেই আবার বেশ টানটান, সজীব হয়ে উঠেছে সে l আমারও প্রাণশক্তি ফিরে এসেছে ওর সঙ্গে সঙ্গেই l আর কষ্ট নেই …

বই, আমার সই

মাঝে মাঝে মনে হয় নেই হয়ে মিশে থাকি l অল্প কথার মানুষ বলেই, বইয়ের মধ্যে বন্ধুর মুখ দেখতে পাই l তাই ওই কিচ্ছু না হয়ে মিশে থাকার মুহূর্তগুলোই বুঝি বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যাবার সময় l কারণ একটি ভালো বই, আমাকে যে ভাবে বুঝতে পারে, আর কেউ পারে না l তখন সেই একফালি রোদ্দুর আসা জানালার ধারটা, অথবা সেই ছাদের সিঁড়ির ধাপটায় যেখানে বর্ষাগন্ধী বাতাস বয়ে যায় সতত, সেই সব জায়গার জন্যে বড়ো মন কেমন করে l এসব জায়গায় বসে, পড়বার মতো, ভিন্ন ভিন্ন বই রয়েছে আলমারিতে l কোন বইয়ের সঙ্গে কেমনতরো মিতালি, সে শুধু আমিই জানি l বই পড়ে শেষ হয়ে যাবার বেদনাতে দ্রব হয়ে থেকেছি কত কত দিন l তারপর, কি করি, কী করি, ভাবতে ভাবতে আবারও হয়তো অমন কোনও একটি ভালোবাসার বইয়ের দেখা পেয়ে বর্তে গেছি l কতবার কোনও চরিত্রের জন্যে দুঃখে কেঁদেছি, মনে পড়ে l এমন হয়েছে শতবার l কাছের বেড়ালছানাটির মতো মিউমিউ করে বেড়িয়েছে সে, অনুক্ষণ l কোলে তুলে নিয়ে আদর আত্ম্যি যত্নে লালন করেছি বহুদিন l

সেই মেয়েবেলাতে যখন টিচার বলতেন, এখন পড়ো, সাইলেন্ট রিডিং, কি আনন্দই যে পেতাম …

ওপরা উইনফ্রি একবার বলেছিলেন, কোনও কোনও নারীর জুতো ব্যাগের জন্য যে দারুণ লিপ্সা থাকে, দুর্বলতা থাকে, আমার সেটি রয়েছে বইয়ের জন্যে l সহমত l ভোর পাঁচটায় ক্লাস থাকলেও বইয়ের এমন অমিতসঙ্গ কিছুতেই ছাড়তে না পেরে শুতে যাই যখন তখন বইয়ের শেষ পাতায় পৌঁছনোর দুঃখ নিয়ে l এতো বই, কি যে হবে ভাবতে ভাবতেও এই আশায় বই কিনে যাই যে ১৭৩ বছর বেঁচে থাকলে হয়তো পড়ার মতো বইয়ের অভাব হবে না l
সেই যে টমাস জেফারসন যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৮১২ সালে, যখন লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস জ্বালিয়ে দেওয়া হোলো, তখন তাঁর নিজের লাইব্রেরির সব বই দান করে দিয়েছিলেন, আবার সব নতুন করে শুরু করবার জন্যে l বাস্তবিক, কেউ কি জানে কখন শত্রু এসে লাইব্রেরি কে লাইব্রেরি বই ধ্বংস করবে? তখন মানুষের মনের খাদ্য যোগাবে কে?

আহা এমন কেন হয় না, বেশ ঘন মেঘপূর্ণ বরষাদিন, হাতে একটিও কাজ নেই, ঘুচুমুচু একটি নরম কাঁথা, এক কাপ গরম দার্জিলিং সেকেন্ড ফ্লাশ, আর বই … ল্যাদ … পুরো স্বর্গ! আমি যদি এক্ষুনি এই বাড়িটা থেকে, এই সবকিছু থেকে, এই বিশ্রী সব কাজকর্ম, ঝুটঝামেলা থেকে পালাতে চাই? তাহলে বই আমার একমাত্র রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপখানি, তাই না?

তাই বলছিলাম আর কি, বড়ো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বলতা আমার, কফি, জানালার ধার, বর্ষা বিকেল আর বই l
আর জনাথন এডওয়ার্ড দারহামের কথানুযায়ী – বেশি কি আর চেয়েছি আমি? একটা সাধারণ ছোট বাড়ি, একটা রান্নাঘর, সারমেয়টির একটু দৌড়োদৌড়ি করবার জন্যে একফালি উঠোন, আর একটি গুপ্ত দরজা, যার ঐপিঠে একটি অসাধারণ লাইব্রেরি, মইওয়ালা, খুব উঁচু উঁচু তাকের থেকে বই নামানোর জন্যে, আর একটি অদ্ভুতুড়ে লাইব্রেরিয়ান, সেই ক্যান্টারভিলের প্রেতাত্মারা মতো … কেমন? এই কি বেশি চাওয়া ?

নারী

আমি নিজে আমার অন্তরের বাহিরের নারী সত্ত্বাটিকে সম্মান করতে পারলে আজ নারী হওয়ার সার্থকতা l

কর্ম

আপনি বেশ ভাবছেন, যে ঐতো মরে গেলুম আর সব শেষ, ভবলীলা সাঙ্গ হলো, আর কিচ্ছু নেই, আপনি দেহের সঙ্গেই বিলীন হলেন l কিন্তু এতো এতো মানুষজন যে বলে গেছেন আত্মার অস্তিত্বের কথা সে সব কি কেবলই সব মিথ্যে? সব ফাঁকি? উঁহু তা তো নয় l একটা ঘটনা বলি, বিশ্বাস করা না করা অবশ্য আপনাদের উপর l আমার মায়ের বাবা, দাদুভাইয়ের তখন শেষ সময় আগত l নতুন শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয়েছে আমাকে দাদুর শেষ সময়ে যাতে কাছে থাকতে পারি, তাই l কিডনির অসুখ, তাই হৃদযন্ত্রও খুব দুর্বল, তার ওপরে বয়স l রাতে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ, দাদু বললেন, বাথরুমে যাবেন l বাথরুমে সেরে এসে এড়িয়ে এড়িয়ে মাকে বললেন, ওরে জল দিতে পারি নি l আমরা সবাই বাইরে ঢাকা বারান্দায় অপেক্ষারত l মা ধরে ফেললেন দাদুভাইকে আর তখনি মায়ের কোলে শেষ হয়ে গেলেন দাদু l
আমিও কাছে, স্পষ্ট দেখলাম, মুখ থেকে একটা ধোঁয়ার মতো বল বেরিয়ে এলো, মাকে, ভাইবোনদের দেখলাম, ওই যে মা, দেখো দাদুর আত্মা l স্পষ্ট দেখা, আজও মনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য l আত্মা যে আছেন, টের পেয়ে গেলাম, ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, এই দৃশ্য দেখতে পাবার জন্যেই l কিন্তু তাহলে তো দেহেই মুক্তি নয়? এই যে এতো খারাপ কাজ, খারাপ কথা চলছে চারিদিকে? তার কি হবে? না, সেই সব ছাপ ফেলে যাবে ওই আত্মার ওপরেই l সেইগুলি কর্ম l আত্মা চিরকালই ওপরে উঠছে একটু একটু করে পরমাত্মায় বিলীন হবার উদ্দেশ্যে l আর সেই উত্তরণে বাধা সৃষ্টি করছে, খারাপ কাজ, ক্ষতিকর চিন্তা আর মন্দ কথা l আত্মার উর্দ্ধগামীতা এইসব খারাপ ব্যাপারস্যাপার রোধ করছে l

একটু ভেবে দেখার ব্যাপার বৈকি … জ্ঞানীগুণী জনেরা তো আর মিছে কথা বলে বা লিখে পাতা ভরান নি ….

ভালোবাসায় থাকি

আজ একটু কিছু লিখতে ইচ্ছে গেলো …

ফেবুতে বিষোদ্গারণ দেখে মনটা ভেঙে যায় l যে সব মানুষজন অন্যকে কটূক্তি করে সে নিজে একদম ভালো নেই, এটাই বোঝা যায় l এতো গরল উত্থিত হয় কেন, কিভাবে? এতটাই বিষ? যে কারও সাংঘাতিক ক্ষতি চাইতেও পিছ পা হয় না মানুষ? অথচ ঠাকুরের কথানুযায়ী এটাই সবথেকে বড়ো অপরাধ l স্বপ্নেও কারও ক্ষতি চাইলে, কর্ম তাকে নাগপাশে বেঁধে ফেলবে, এর থেকে মুক্তি নেই l কর্ম কিনা বুমেরাংয়ের মতোই, তাই যা করি আমরা ভালো খারাপ, তাই আবার ফেরত পাই যে l ঠাকুর আর কিচ্ছুটি চান না l সবার জন্য ভালো চিন্তা, ভালো প্রার্থনা, এটুকুই মাত্র চান l এটি করলেই অচিরে এইসব ভয়ঙ্কর চিন্তাভাবনা থেকে মুক্তি পেয়ে মনটাকে ফুরফুরে আনন্দময়, নির্মল করে ফেলতে পারা যাবে l জলে যেমন এতটুকু নির্মলী ফেললেই জল পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে উঠতে পারে, মনও তেমন l প্রতিমুহূর্তের চিন্তার ওপর নজর দেওয়া, ভালো চিন্তা আর মানুষের, তথা সমস্ত প্রাণীর ভালোর জন্যে ভাবা, এ কি আর এমন দুরূহ কাজ l নিজের সময় নষ্ট করে হেট্ স্পিচ লেখার থেকে সে অনেক বেশি সহজ, অনেক বেশি আনন্দদায়ক l সেই যে জন লেনন বলে গিয়েছেন, মনে করো পৃথিবীর সব্বাই শান্তিতে আছে, ভালোবাসায় আছে, তুমিও সেই মিছিলেই যোগ দাও না কেন, এস আমরা সবাই ভালোবাসায় বাঁচি … আর এই ভালোবাসার গাছটিতে জল দিও একটু রোজ, দেখবে কেমন বেড়ে ওঠে সে তরতরিয়ে l

আসুন না, সবাই ভালোবাসায় থাকি, আনন্দে থাকি, শান্তিতে থাকি …

ভালো বাসার দিনকাল

তবে এর মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের এক মুশকিল ডেকে এনেছি l বইয়ের আলমারি তো সব ক’টি উপুড়ঝুপুর ভর্তি l এর পরেও সব টেবিলে বই, এখানে বই, ওখানে বই, সেখানে বই, শাশুড়িমাতার থেকে লব্ধ অমূল্যরতন সব বইয়েরা, আমার মায়ের, বাবার বই নিয়ে এসেছি এইখানে, আগের, পরের বই আর বই l বলবো কি, এখন বইয়েরা বিছানার ‘পরে আমার সঙ্গে শুচ্ছেও l মাথার কাছে আগে শুধুই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত আর মায়ের কথা ছিল l এখন সব সব বইয়েরা l একটাই সুবিধে, হাত বাড়ালেই বন্ধু – বই l মুশকিলের কথাটি হলো এখন গুগুল ছানা পা রাখার জায়গা পাচ্ছে না, একটু এদিক ওদিক হলেই চেঁচিয়ে উঠি, ওরে সব্বোনেশে ছেলে রে, ওরে আমার কথামৃততে পা না লেগে যায় l ওই রে আমার বাঘের বইতে পা দিলি? এই মরেছে ‘লাল টুপি’ বইটার দফা রফা করে ছাড়লি বাপ্? গুগুল আর কি করে, কাঁচুমাঁচু মুখ করে এক পা উঁচিয়ে থাকে l একটু ভেবে নিয়ে বলে, আচ্ছা আমি না হয়, তোমার বইয়ের জন্যে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেব, তাহলে হবে তো? ভাবলুম, এ তো বেশ, ইচ্ছে ছিল, সায়ন, পল্লবী আমার বইটি হাতে ধরুক, ছবি তুলি l সে ওরা এলে হবে’খন… তা আপাতক, এও মন্দ হবে না!

মোটকথা, এখন ঘুম কমেছে, পড়া বেড়েছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আনন্দ … ভালো থাকাথাকির আশ্বাস !

তা এইসব ব্যাপার আর কি …

অপর্ণা গাঙ্গুলী

# HMB – His Mother’s Book

# ভালো বাসার দিনকাল

# অপর্ণা গাঙ্গুলী

# প্রকাশক – পালক

ভালো বাসার দিনকাল

সেই আমার ১০৩ নম্বর বাড়ির ঘুঁটের ঘর, গানের ঘর, বইয়ের ঘর, চিলেকোঠা পেরিয়ে পেরিয়ে আমরা তখন পৌঁছে গেছি মেজদির আমোদঘরে l চলো দেখি, কী হচ্ছে সেখানে …

‘……. কখনো বা নাপতিনি বউ এসে পড়ত বিষ্যুদবার হলেই l তার সাথে থাকত এক ঝুড়ি সাজের সামগ্রী আর থাকত ঝুড়ি বোঝাই এ বাড়ি সে বাড়ির আচারে-কাসুন্দে গপ্প l বলব কি, চোখ গোল গোল করে সবাই বেশ গিলত সেইগুলো l মেজদি অবিশ্যি বউঝিদের এইসব গপ্প শোনানোর পক্ষপাতি ছিলেন না l এ সব ব্যাপারে ‘স্ট্রাটিজিক্যালি’ খেলতেন বেশ lখুব কড়া ছিলেন কিনা মানুষটি l তাই কি ভাবে সেই সব চাটনি গপ্পের মোড় ঘুরিয়ে নিছক মজার আড্ডায় নিয়ে গিয়ে ফেলতেন বেশ শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরে, তাই বলি l মেজদি আধো আধো সুরে বলতেন, বলি ‘অ বউ, যদি এসব গিলে এদের গুরুপাক হয় তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন l’ নাপতিনি বউ পান খাওয়া দাঁতে হেসে খুন হত – জিভ কেটে বলত, ‘মাইরি মা, যা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যে না বলিব l’ বলেই গড়িয়ে পড়ে হাসতে থাকত ভারী l যারা মজা পেত পেত আর যারা মনে করত, এই বোধহয় আমাকেও নিয়ে এইসব গপ্প হয় টয় তারা গুম হয়ে যেত l আর তখনি তাদের হাসাবার জন্যে মেজদি ছড়া কেটে বলতেন – ‘আচ্ছা বল তো, কি সে জিনিস যা, কাঁচায় তুলতুল পাকায় সিঁদুর ? যে না বলতে পারে … ….. ‘ তা এই সব আর কি l

# ভালো বাসার দিনকাল

# অপর্ণা গাঙ্গুলী

# প্রকাশক – পালক

ভালো বাসার দিনকাল

বড়োদের জন্যে রূপকথা “ভালো বাসার দিনকাল”

কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু আধটু মনের কথা লিখে রাখি l সে সব আমার হারিয়ে ফেলা মেয়েবেলাটির জন্যে মনকেমনের গল্প l অনিকেত আমি, চিরকাল খুঁজে ফিরেছি ভালো বাসা l তা সেইরকমের কিছু বাসাবাড়িকে নিয়ে লেখা গল্পসল্প রয়েছে এতে l পালকের শ্রী অঞ্জন ভট্টাচার্য্য খুব যত্ন সহকারে বানিয়ে দিচ্ছেন এই বই, ‘ভালো বাসার দিনকাল’ l একরাশ কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁকে ও পালকের সকলকে l প্রচ্ছদশিল্পী শ্রী তপন রায়কে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ l

প্রকাশক – পালক

ধনলক্ষ্মীর কথা

ধনলক্ষ্মীর কথা পড়লাম ইমেইলে আসা খাদ্য সরবরাহকারী এক সংস্থার ক্রোড়পত্রে l দক্ষিণী মেয়ে ধনলক্ষ্মী সম্প্রতি তার মাকে হারিয়েছে l বাবা গত হয়েছেন অনেকদিন আগেই l এখন তার বেঁচে থাকাথাকির প্রেরণা তার দুই দিদি, তাদের সংসার ছেলেমেয়েকে ঘিরেই l মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা ধনলক্ষ্মীকে অনেকেই পুরুষ বলে ভুল করে যখন সে মাথায় হেলমেট চাপিয়ে খাদ্য সরবরাহ করতে বেরোয় তার দু চাকার যানে l হাসিখুশি ধনলক্ষ্মী একমাত্র সম্পদ ওর হাসিখানি l কাজেও কোনো গ্ল্যামার নেই ওর, রূপেও নেই চাকচিক্য l নিজেকে সুন্দর রাখতে দিনের পর দিন খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়ে এনোরেক্সিয়ার রোগী হবার তাগিদ নেই ওর l স্বচ্ছ, সুন্দর, প্রাণোচ্ছল নদীর মতো বয়ে চলা এক স্রোতস্বিনী ও l বড়ো বেশি উচ্চাশা, লোভ, পরশ্রীকাতরতা যেন ওর এই স্বাভাবিক বয়ে চলাকে কোনোদিন প্রতিহত না করে l জীবনের আড়ম্বরের পলিমাটি যেন ওর এই সুন্দর চলাকে ব্যাহত করতে না পারে l সহজ সরল জীবন, সত্যনিষ্ঠা, আনন্দ, শান্তি, সুন্দর মনন যেন সব ধনলক্ষ্মীদের শক্তিমতী করে তোলে, এই প্রার্থনা l
কষ্ট করে অর্জন করতে শিখুক সন্তান, না চাইতেই তার হাতে ইপ্সিত সামগ্রী তুলে দেওয়া বাবা মায়ের ভুল পদক্ষেপ l শিশুবেলায় আমাদের একটা ফাইভ ষ্টার পেতে হলেও অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ সময় l ধনলক্ষ্মীদের থেকে এবং এভারেস্ট বিজয়িনী ছন্দা গায়েন, কলকাতার সর্ব কনিষ্ঠা বাস চালিকা কল্পনা মন্ডল এবং আরো এমন সাহসিনীদের জীবনের পাঠ পেয়ে গেলে, জীবন বড়ো সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠে l

বিরহ

অনেকদিনের পর, বিরহ কাটিয়ে তুমি এলে,
পাত পেড়ে দেব, ভাত বেড়ে দেব, খাবে বসে –
দুপুর-গড়িয়ে-যাওয়া কামরাঙা বিকেলে l
বাটি মেপে বাসমতি ভাত, সুবাস ছড়াবে বিরহ-আদর-মাখা l

ছন্দ অনুষ্টুপ l
শীতল তালপাখার পাখা থেকে চন্দন-জল টুপটুপ l

এই মধুমাস l
পাঁচ ভাজা, পঞ্চ ব্যঞ্জনে, সযত্নে লালিত কিছু কথা ছিল রাখা …

দারুণ আদরে বোনা খুনচিপোষ ঢাকা,
এতদিনে পেয়েছে প্রকাশ l

বিরহের শেষ l এর পর হিসেবে নিকেশ l

আজ রাতে ঝড় উঠবে, ঝড় l
এমন বিরহ পেতে বেঁচে নেবো হাজার বছর l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ছবি – শ্রী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়

যাত্রা

যাত্রা শুরুর আগে দুয়ারে দাঁড়িয়ে চার চাকা শকট, স্করপিও গাড়ি l বেশ শক্তপোক্ত যান এ, কারণ আমাদের সবাইকে নিয়ে এ গাড়ি যাত্রা করবে শিলিগুড়ি থেকে মানেভঞ্জন বলে একটি পাহাড়ি জায়গায় l এ সব গাড়ি দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় চলতে পটু l যাইহোক, মানেভঞ্জন থেকে পরের দিন যাত্রা করবো টংলু উপত্যকার উদ্দেশ্যে l সান্দাকফু যাবার পথে সেই সুরম্য স্থান l সেখানেই এবারে আস্তানা হবে আমাদের এবং আমাদের বন্ধু বান্ধবীদের l কুচোকাচা সহ জনা আটেকের একটি ভ্রমণ পিপাসু দল l

দুপুর দুপুর বেরিয়ে পড়া গেল l তার আগের রাতে কলকাতা থেকে যাত্রা করে সারারাত ওপরে কাঁচ লাগানো দিব্য টুরিস্ট বাসে আকাশ দেখতে দেখতে আমরা সবাই ভোরবেলাতে পৌঁছেছি শিলিগুড়ি l দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে যাত্রা শুরু l চিতল মাছের পেটি আর গরম ভাত, খাওয়াটা জাস্ট জমে গেছে যাকে বলে l স্করপিও চালাচ্ছে এক পাহাড়ি ছোড়া l আমি বরাবর সামনে বসতে ভালোবাসি তাই অধিকার করেছি সামনের সিট্ l পাহাড়ি সে চালকটি মাঝপথে তার পনেরো বছরের বৌকে তুলে নিলো পাশে l হায় ভগবান l ঐটুকু পুঁচকে ছেলে গাড়ি চালাবে ভেবেই হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধোচ্ছে, এর মধ্যে আবার বৌ ? ছেলে খোশমেজাজে গান গাইছে, আর কচি নবপরিণীতা বৌয়ের সঙ্গে সোহাগপূর্ণ কথাবার্তা বলছে l পেছনের সিটে বসা সঙ্গী সাথীরাও দেখি গপ্পে গানে মত্ত l আমি সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চেষ্টা করেও বারংবার ব্যাহত হই, ওই এক চিন্তায় l এ কান্ডারী আমাদের তরাতে পারলে হয়!

চলতে চলতে দ্রুত বদলে যেতে থাকছে দৃশ্যপট l রাস্তার দুধারে কখনো জঙ্গল, কখনো আবার পাহাড়ী ঝোরা l প্রাকৃতিক দৃশ্য উধাও হয়ে এসে গেলো ছোট ছোট জনবসতি l কার্শিয়ং কালিম্পঙের রাস্তায় বাহারী কন্যেরা হেলেদুলে চলেছে ফুলের মতো l তাদের ফর্সা গালে ডালিম ফেটে পড়ছে l রঙ্গীন বাকু পরিহিতা মেয়েরা পাহাড়ী সুরে গান গাইছে, পথ চলছে সার বেঁধে l কাছে দূরে মোমোর দোকানে বৈকালিক জলখাবার তৈরীর প্রস্তুতি করছেন গ্রাম্য মহিলারা l ইতিউতি পাহাড়ী লোমওয়ালা কুকুর, রংচঙে মানুষজন আর বাহারী ফুলে জায়গাটিকে যেন রূপকথার দেশে নিয়ে হাজির করেছে অতর্কিতে l আমি ভাবতে ভাবতে চলি আর রঙিন সেই স্বপ্নপুরী বদল হয়ে ফস করে যাত্রার মোড় ঘুরে যায় কেমন l এই তো ছিল সেই বাহারী ঘরদোর, মেয়েদের দল ; কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় কোথায় গেলো সেসব?

ওমা তার বদলে খাড়াই পাহাড় একদিকে আর তার কোল ঘেঁষে এক চিলতে রাস্তা l আর তার পাশে? অতলান্ত খাদ l আমি জানলা দিয়ে বাইরে দেখতে গিয়ে ভীষণভাবে মাথা ঘুরে যায় l সেই পাহাড়ী চালক আর তার সহধর্মিনীর ভ্রুক্ষেপ নেই l সঙ্গীসাথীদেরও সেই এক হাল l তখন মনে হয়, ওই ভয়ঙ্কর যাত্রায় যেন আমি একাই এপোক্যালিপসের টিকেট কেটে উঠে বসেছি এই অলক্ষুনে যানবাহনে l চোখ বুজে ফেলি আর তখনি মনে আসে l শরণাগতি l টোটাল surrender! সে ছাড়া আর উপায় কি l পাহাড়ী রাস্তায় ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে l ছেলেটি অবলীলায় বলে ওই পথে নাকি মাঝে মাঝে হাতি নেমে এসে রাস্তা আটকে দেয় l সোনায় সোহাগা এমন হলে l আমি তো শরণাগতির পথ বেছে নিয়েছি l ওদিক থেকে আসা গাড়ির আলো দেখলে বোঝা যায় গাড়ি আসছে l আর কি নিপুণ দক্ষতায় এই ছেলেটি পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না l আমার বা দিকের চাকার পাশে তিলার্ধ জায়গায় নেই ! হাতের মুঠোয় প্রাণ আর মুখে ঠাকুরের নাম নিয়ে বসে রয়েছি গাড়িতে l চলতে চলতে চলতে চলতে অবশেষে এই যাত্রার শেষ হলো l যাত্রাশেষে, এক পাহাড়ের ওপর অবস্থিত একটি জায়গার কাছে থেমে গিয়ে কিশোর থাপা জানালো আমরা পৌঁছে গেছি l অনেক উপরে ওই ডরমিটরির ঘরে যে সুখশয্যা পাতা ছিল আমাদের জন্যে তার মতো ভালো নিজের বাড়ির বিছানা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না l

জীবন আসলে এক বিরাট যাত্রা l আর আমরা সবাই সেই যাত্রা পথের যাত্রী l বৃদ্ধ কবি শেক্ষপীয়ারের মতে, জীবন হলো যাত্রার রঙ্গমঞ্চ, যেখানে আমরা প্রত্যেকেই রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা l সে যে যাত্রার কথা বলাই হোক না কেন, আমরা অনন্তের পথ যাত্রী l পথে সরাইখানায় একটুকু বিশ্রামের জীবন, তারপর আবার পথচলা l যাত্রা শেষে গন্তব্যে নেমে যেতে হয় আমাদেরও l সেই যে গানটা “পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাবো……………. l” পরের দিন আবার নতুন যাত্রা – নতুন জন্ম, নতুন অঙ্গীকার, নতুন পথ চলা l

চরেইবেতি ll

অপর্ণা গাঙ্গুলী

আজকের শব্দ: “যাত্রা”

কামেশ কি মায়ি

আকাশে তুলো তুলো সাদা মেঘ ভাসলেই পুজোর গন্ধ আসে আকাশে l হেসে ওঠে আকাশ বাতাস l আর এই সব সময়ে কামেশের মাকে খুব মনে পড়ে আমার l বিহারের কাটিহারে ছিল তার বাড়ি l জুট মিলের বাংলোর অনতিদূরে একটা খড়ের ঝোপড়িতে তার ঘরবসতি কিনা l কামেশের বাবা মারা যাবার কয়েক বছর হলো l জুটমিলে কাজ করতো কামেশের বাপ্ l এক শীতের রাতে গলায় মাফলার পরা ছিল বেচারার আর সেই মাফলার কিনা বড়ো মাকুতে জড়িয়ে ফাঁস লেগে এক্কেবারে শেষ l উল্কি পরা হাত অন্য হাতের ওপর চাপিয়ে মাকে বলতো কামেশ-কি-মা – ইতনা তক জিভ নিকাল আওবা, কি বোলে বাওহুজি, ওসি দিন সে সুহাগ গেইল বা l”

সদাহাস্যময়ী নারী l চোখে জল এলেও মুখের হাসি মলিন হয় না l আমি বসে বসে ভাবি, সুহাগন কামেশ-কি-মা কে l পায়েল বিছুয়া ওদের এয়োতির চিহ্ন l আর খিলখিল হাসি, যে হাসি মলিন করতে পারেনি অকাল বৈধব্যও  l হয়তো কনুই অবধি মেহন্দি রাঙানো ওর নিটোল ফর্সা হাত দুটি l কাঁচের চুড়ি সে পরতো বৈধব্য দশাতেও l সুনা সুনা হাত পাও আচ্ছা লাগে না তার বলেই l চৌক থেকে কিনে আনে রেশমি চুড়ি l আমাদের ডেকে হাত ভরে চুড়ি দেয় নৌরাত্রি উপলক্ষে l এই দেওয়াতেই তার আনন্দ l ১৫ বছরে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে l রূপমতী থাকে শ্বশুর বাড়ি l পূজা পালিতে মায়ের কাছে আসে সে l দাঁড়িয়ে থাকে মায়ের কাছ ঘেঁষে আর অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে আমাকে আর বোনকে l শহরের খাটো জামা প্যান্ট পরা আজব মানুষ আমরা ওর কাছে l আর মায়ের কাজ শেষ হতেই দৌড়ে চলে যায় মায়ের পিছু পিছু l আমি ওর মধ্যে কামেশের মায়ের ত্রস্ত চলন দেখে ফেলি l ওর নুপুর রুনুরুন বাজে,  নুপুর তো বাজে না, হাসে l হাসছে কামেশের মাও খিলখিলিয়ে l হলুদ লাল হিন্দুস্থানী শাড়ি পরার ভঙ্গিমায়, নিক্কণে, শিঞ্জিনীতে, মেহেদির রঙে, ভিগি মেহেদির মদির সুবাসে, সিঁদুরে কুঙ্কুমে, কামেশের বাপের সোহাগে ভরভরন্ত মধ্য যৌবনা কামেশের মাকে … আজ হঠাৎ মনে এলো কেন কে জানে l

দীপাবলির রাতে সে তাঁর আঁধার ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে নাকি অপেক্ষা করতো কামেশের বাবার l কি জানি, যদি আসে l যদি কিছু বলার থাকে তার l আচমকা মৃত্যু, কত কথাই না বলা থেকে গেছে হয়তো l ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে উৎসবান্তে l রাত জেগে জেগে কখন ঘুমিয়ে গেছে কামেশের মাও l কাল ভোরে মুন্নিদের বাড়ি কাজ আছে না l

ভোরের আলো ফুটে উঠতে চোখ খোলে কামেশের মা l দিয়া নিবে গেছে সারারাত জ্বলে জ্বলে l আর ফেরেনি কামেশের বাপ l তবু নতুন আশায় বুক বেঁধে নিয়ে কাজে লাগে l গরু ছাগল গুলোকে চরাতে যাবে কামেশোয়া l ওর দানা পানি বেঁধে দেয় l

এক গাল হেসে আমাদের দরজায় এসে দাঁড়ায় কামেশের মা l কল্পনায় ওর নুপুর হেসে ওঠে, ওর কঙ্গনা হেসে ওঠে, ওর কানের বালি হেসে ওঠে শরতের সোনা মেঘের সঙ্গে সঙ্গে l

©অপর্ণা গাঙ্গুলী

কামেশের মা

আশ্বিনের শেষাশেষি কিংবা কার্তিকের শুরুতে যখন একটু আধটু উত্তুরে হাওয়া দিতে শুরু করে, তখন বড়ো জাড়া লাগে কামেশ-কি-মায়ির l ওই তো ঐটুকু একটা খড় ছাওয়া ঝোপড়পট্টি l তাতে  তিন ছেলেপেলেকে নিয়ে ওর ঝিলিমিলি সংসার l আরো কিছু লালনীল রঙ লাগার কথা ছিল বটে তাতে, তবে এখন মেহেন্দি ছুটে যাবার পর থেকে বড়ো বেরঙ ওর যাপন l বেরঙ আমরা ভাবছি, কিন্তু আদপেই যে তা নয়, বুঝেছি পরে l

আমার মায়ের দেওয়া উলিকটের শালটা কানমাথা মুড়ি দিয়ে পথ চলে ও l এখন সক্কাল সক্কাল ঠান্ডা পড়ে যায় এখানে, বিহারের কাটিহার অঞ্চলে l ওই দূরে মুন্নিদের বাড়ি দেখা যায় l সক্কাল হতে না হতেই, বহুজী আর মুন্নিদের জন্যে ছটফটায় ওর মন l আজ চৌক যাবে, মোটা মোটা মাগুর মাছ কই মাছ নিয়ে যাবে বহুজীর মেয়েদের জন্যে l কোলকাত্তায় পড়াশোনা করা মেম মেম  মেয়েগুলো, কী ভালো কী সরল l রূপমতির বিয়ে হয়ে যাবার পর, তিন বেটা কে নিয়ে ঘর বসত ওর l মুন্নিদের হাতে টিপে টিপে তুলে দেয় চৌক থেকে সংগ্রহ করা লাল পিলা, হরা রেশমি চুরি l ওদের সাজাতে চায় মনের মতো করে l এতো এতো মেহন্দি এনে ওদের হাতে এঁকে দেয় রংবিরাঙ্গি ফুল-পত্তি l

কামেশের বাবা মারা যাবার কয়েক বছর হলো l মায়ের কাছে বসে বসে গপ্পো জোড়ে ও l জুটমিলে কাজ করতো কামেশের বাপ্ l এক শীতের রাতে গলায় মাফলার পরা ছিল বেচারার আর সেই মাফলার কিনা বড়ো মাকুতে জড়িয়ে ফাঁস লেগে এক্কেবারে শেষ l উল্কি পরা হাত অন্য হাতের ওপর চাপিয়ে মাকে বলে, কামেশ-কি-মা – ইতনা তক জিভ নিকাল আওবা, কি বোলে বাওহুজি, ওসি দিন সে সুহাগ গেইল বা l” তারপর আর কি, মা আর আমরা মেয়েরা কামেশের মায়ের দুঃখে কেঁদে বুক ভাসাই l

কামেশের মা কিন্তু কারণে অকারণে খিলখিলিয়ে হাসে l আমাদের একটু অবাক লাগলেও ওই পাহাড়ী ঝর্ণার মতো হাসিকে  অবজ্ঞা করি  কিভাবে l তবু তো এখন পায়ের নুপুর বাজে না, বিছুয়া সাজে না l এয়োতির চিহ্ন সে সব l কামেশের মা কে সে’সব আর পরতে নেই l তবু ওর পায়ের চলে ঝর্ণার চলন লেগেই থাকে আর হাসি ঠিকরে ওঠে যখন তখন ফিনিক দিয়ে l ওর মুখের ঝিকঝিল্লি হাসিতে, ওর চোখের তারায়, ওর হিন্দুস্থানী শাড়ির ভঙ্গিমায়, ওর না-পরা-নুপুরের-নিক্কণে-গহনার-শিঞ্জিনীতে l কিছু কিছু মানুষের মুখের সঙ্গে হাসিটি ফেভিকলের বন্ধনে লেগে থাকে l এরও তাই l খুব দুঃখের কথাও যখন হেসে হেসে বলে কামেশের মা, তখন সে আমাদের শিক্ষাদাত্রী হয়ে ওঠে নিমেষেই l একবার কিভাবে যেন ওই খড়ের ঘর পুড়ে গেলো ওদের l তখন দেখলাম হেসে হেসে মা কে বলছে, বহু জি অব ক্যা করে l উপরওয়ালা কো জো মর্জি l মা ওর ছেলেপেলে সহ ওকে ঘরে ডেকে শোয়ান, ঘর ছাওয়া অবধি l আর কামেশের মা হেসে হেসে ওপরওয়ালার প্রশস্তি গেয়ে ওঠে l

আমাদের বাংলো থেকে ওর খোড়ো ঘরের দূরত্ব বেশি নয় l তবে যেতে হয় ঘুরে এক প্রশস্ত মাঠ পেরিয়ে l একদিন খুব রাত হয়ে গেছে বাড়ি যেতে l অতিথি আসতে কাজ মিটিয়ে বাড়ি যাবার জন্যে পা বাড়ালো কামেশের মা l মা ছেলেদের জন্যে খাবার বেঁধে দিয়েছেন l হঠাৎ খেয়াল হলো, এতো রাতে যাবে? তাকে বলতেই আবার সেই ফল্গুধারার মতো হাসতে হাসতে বললো – ভয় কি বহুজী l হরবখত কামেশের বাপুজী আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে গো l পিছে পিছে আসে l বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায় l অম্লানবদনে এই ভয়ঙ্কর আস্বাসের কথা মাকে শুনিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে কুয়াশায় মিলিয়ে গেলো কামেশ কি মায়ি l

রেখে গেলো তাঁর সুনির্মল আত্মার কস্তুরী সুরভীখানি l

পিঠে-মাঠার গল্পগাছা

আমাদের দিদিমা ঠাকমারা কেন যে পিঠে-মাঠা কথাটি একসাথে বলতেন তা শুধিও না বাপু, উত্তর নেই আমার কাছে l জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, খাও দিকিনি, অত প্রশ্ন কর না l পাতে গরম গরম পিঠে পড়লে আর অন্য দিকে মন থাকে কি? পিঠে ভাজার ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ শুনতে পেতাম ইস্কুল থেকে ফিরেই l আর দুদ্দাড়িয়ে এসে হাজির হতুম রান্না ঘরেই l আমাদের তর সইলে তো, সে পিঠে টেবিলে তোলার l দিম্মা কাঠের জ্বালে পিঠে ভাজতেন মনে পড়ে l সে যে কি রমণীয় ব্যাপার স্যাপার l দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার মহাশয়ের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে বড় মধুর করে সে পিঠে তোয়ের করার বর্ণনা দিয়েছিলেন l দাসী নাকি বানালে আস্কে পিঠে-ঘাসকে পিঠে-চাস্কে পিঠে আর রাজার বউ রাণী, তিনি বানালেন, সরু চাকলি, মাল্পুয়া, পাটি সাপটা আরও যেন কী কী সব l সেই বর্ণনার ভাষার যা স্বাদ, তাতে পিঠে না-খাবার দু:খ ভোলা যায় lঠিক বছরের যে সময়টিতে ছাদের দিক থেকে একটি সিমসিমে বাতাস বইতো আর সেই হাওয়াবাতাসে বুড়ি ঠাক্মার ঠাকুরঘরের থেকে নতুন ধান, নতুন ফল, নতুন সব্জীর গন্ধ নাকে আসতো l বুড়ি ঠাক্মা সেদিন নতুন সব কিছু ঠাকুরকে দিতেন l কুচি কুচি করে কাটা ফল, মুগ ডাল, নতুন আতপ চাল দিয়ে নবান্ন সাজানো হতো কলার পাতে লক্ষ্মী দেবীর সামনে l তাতে থাকতো নতুন পাটালির টুকরো l ধুপ ধুনোর গন্ধের সঙ্গে, নতুন উপাচারের গন্ধ মিলে মিশে আমাদের কেমন মন কেমনগুলোকে উপড়ে ফেলে মন ফুরফুরে করে দিতো সে সব l সে আবেশে ভেসে গিয়ে, বছরের প্রথমে তখন নিজেরা নিজেদের প্রতিজ্ঞা করতুম, এবছর থেকে কোনো ফাঁকি নয়, স্রেফ পড়াশোনা l তারপর সারি দিয়ে কলাপাতায় দেওয়া দুধ কমলালেবুর কুচি, শশা আপেল কুচি, নতুন কচি কড়াইশুঁটির দানা, গুড়ের টুকরো, চাল মুগের জেলার সেই অপূর্ব নবান্নের প্রসাদ পেতুম l খেতে অনেকটা ফ্রুট পুডিং এর মতো কিন্তু দেবমহিমায় বোধকরি এক স্বর্গীয় স্বাদ হতো তার, মনে পড়ে lযা বলেছিলুম, পিঠে মাঠার কথায় আসি l এদিকে হয়েছে কি বামনি বুড়ি, আমাদের রান্না যিনি করতেন, বেবাক সরুচাকলি তোলবার কায়দা ভুলে বসেছেন l বেগুনের লেজের দিকের খানিকটা অংশ দিয়ে কিভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিদ্মা বেশ করে তুলতেন সরুচাকলি কে l সে সব সময় নন স্টিক প্যান এর যুগ নয় যে অল্প তেলেই সরাত করে উঠে আসবে পাটি সাপ্টা বা সরুচাকলি l বামনি বুড়ি কেঁদে কেটে একসা l অমা এ তোমার আমি কি সব্বনাশ কল্লুম মা, কেন আমাকে ভাজতে দিলে বল l সরো দিকিন, বলে ওই শীতকালেও ঘেমে নেয়ে, দিম্মা এইবার বেগুন খানি তুলে নিলেন হাতে আর অদ্ভূত এক হাতের জাদুতে টুপ টাপ করে তুলতে লাগলেন ভাজা সরু চাকলি l কেবল এই কাজের সময় একবার এ গালের পান ও গালে করতেন, আর চশমা ঝুলে যেত নাকের কাছে এই যা l নরমসরম-সোনালী-মধুময় পয়রা গুড় দিয়ে দিতে লাগলেন পাতে l যতই হোক, সেই পয়রার হৃদয়-ভোলানো সুবাস বেরুলেই আমার মন হাহাকার করতে লাগলো ওই ক্ষীরের পুর ভরা পাটিসাপটার জন্যে l সে আবার আর একদিনের অপেক্ষা lএই সময়ে বাউনি বলে একটি উত্সব হয় l দিদ্মা কে দেখেছি খড় দিয়ে আলমারি, দেরাজ বেঁধে রাখতে l তাতে নাকি লক্ষ্মী বাঁধা থাকে সম্বত্সর l সে যাই হোক, লক্ষ্মী দেবী যে সারাটা বচ্ছর এ বাড়িতে বাঁধা তা আমাদের খাওয়া দাওয়ার ধুম দেখলেই বোঝা যাবে l পিঠের দিনে ভাত বন্ধ, কেবল পিঠে আর মাঠা l দিম্মা ভারী একটা ছড়া বলতেন মনে আছে, আউনি বাউনি, তিন দিন পিঠে ভাত খাউনি llক্ষীর পুলি, ক্ষীর কমলা, মুগের ডালের পুলি, মালপো, রস বড়া, চুষির পায়েশ, গোকুল পিঠে, গুড় পিঠে ! ঠিক কথা l গুড় পিঠের কথায় মনে এলো l সে পিঠে বানাতেন বটে ঠাকমা l বড় বড় পাথরের পরাতে সেই পিঠে রাখা হত ঠাকমার ভাঁড়ার ঘরে l বড় জাল দিয়ে চাপা চুপি দিয়ে l নারকোল কুরিয়ে, তার সঙ্গে গুড় আর ময়দা সম পরিমাণে গুলে নিয়ে বেশ আঁটসাঁট এক মিশ্রণ তৈরী হলে ছাঁকা তেলে খলখল আওয়াজ তুলে ভাজা হতো সেই গুড়পিঠে l খেতে অতি মনোরম l মাঝে মাঝে মিহি করে কুরোনো নারকেলের মধ্যেও দু একটি বড়ো ছোট টুকরো থেকে যেত l আর সেই কচকচে ভাগ মুখে পড়লে গুড়ের সঙ্গে মিশে যে অপূর্ণ আহ্লাদের সৃষ্টি হতো তাতে আমরা খুশিতে লুটোপুটি খেতুম আর কি l আর গোকুল পিঠে? খেতে চাইলেই হাত ভর্তি পিঠে দিতেন ঠাকমা আমাদের l খেতে খেতে আমাদের হাত বেয়ে রস গড়িয়ে পড়ত, আবেশে চোখ বুজে আসতো বুঝি বা, ভয়ানক চাকুম-চুকুম আওয়াজ করে চেটে পুটে আমরা পিঠে খেতুম যতক্ষণ না পেট ভরে l এমন স্নেহময়, মন-ভালো-করা খাবার আর ত্রিভুবনে আছে কি না সন্দেহ আছে l ছোটবেলাতে ইতু পুজোর পালুনির দিনে গপ্প শুনতুম, দুটি পিঠে দুই মেয়েকে মা খাইয়ে দিয়েছিলেন বলে সেই উমনো ঝুমনো মেয়ে দুটিকে বাবা বনবাস দিয়ে এসেছিলেন l তাপ্পর অবশ্য তাদের বরাত ফেরে কিন্তু সে তো অন্য গপ্প l আজ অফিস শেষে মনটা বেশ খারাপ হয়েছিল l আহা মা দিদিমা ঠাকমা নেই, কে পিঠে করে দেবে lকাজ থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকতেই স্নেহময়ী মায়াদি, পাটিসাপ্টা এনে হাজির করলো l বড় যত্নে সে বানিয়ে এনেছে দিদি খাবে বলে l জানে অফিসের কাজের ব্যস্ততায় আর এদিকে মন দিতে পারিনি l আশ্চর্য! সেই ছোটবেলার ঠাকমা দিম্মার হাতের সুবাস মাখানো, মধুমযতায় মোড়া সে আনন্দের পুঁটুলি l আমার চোখে জল এলো l কে বলেছে স্নেহ নেই, ভালোবাসা নেই এ পৃথিবীতে l বাড়িতে যা তয়ের করেছে তার থেকে অল্প একটু গুছিয়ে আনতে পারার মনটাকে প্রনাম জানালুম l

নমো মধু: ll

অপর্ণা**

ভালো বাসার দিনকাল – শাল্মলী

সে অনেকদিনের কথা l তখনও এল নাইন বাস চলতো গোলপার্ক থেকে l অনেকেই তাকে বলতো ত্রীতলিকা বাস, এক, দেড়, দুই – তিনটি তলা ছিল বলেই l আর সেই বাসে চেপে আমাদের পাড়ার আহুজা পিসি সোজা গিয়ে নামতেন ক্যামাক স্ট্রিটে, তাঁর অফিসের দোরগোড়ায় l কোনও এক বেসরকারী অফিসের স্টেনোগ্র্যাফার ছিলেন আহুজা পিসি l তখন টাইপ রাইটারের খটখট মাতিয়ে তুলতো যে কোনো অফিস প্রাঙ্গণ l কম্পিউটারের যান্ত্রিক নীরবতা এসে পৌঁছয়নি সে সব দিনকালে l তা এই আহুজা পিসির তিনকালে কেউ ছিল না বলেই হয়তো পাড়ার ছেলেছোকরার দল আড়ালে আদর করে নাম দিয়েছিলো “আহুজা পিসি” l

কারো সাথে পাঁচে না থাকা মানুষটি বেশ নির্বিকার, স্বাবলম্বী এক প্রখর ব্যক্তিত্বের l তবে শুধু আচার ব্যবহারেই নয়, চেহারাতেও সমান তিনি l ইয়া তাল সিড়িঙ্গে, সোজা, দৃঢ়, ঋজু ভঙ্গিমাতে হেঁটে যেতেন আহুজা পিসি l পাড়ার বৌ মেয়েরা পি এন পি সি র ছলে বলতো, ওই তালঢ্যাঙ্গা শরীর, তাই বুঝি বর জোটেনি l হাহ, যেন বর জুটে যাওয়া বা না যাওয়ার ওপর একটি নারীর জীবনের পরমার্থলাভ নির্ভর করে ! মনে মনে ভাবতাম, বেশ আছেন তো l সুন্দর ড্রেস পরে সেজে গুজে অফিস যান, আসেন l হালকা প্রসাধন, বয় কাট চুল, ভালো জুতো, ব্যাগে, ঠোঁটের ঝুলন্ত স্মিত হাসিতে, তিনি মেয়েমহলে এক ঈর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব বটেন l যা হোক, আমার সেই নব্য বিবাহিত, কর্মহীন বোরিং জীবনে বেশ এক ঝকমকে আইডল ছিলেন ওই আহুজা পিসি l সকালবেলা, সাড়ে আটটায়, বাড়ির সামনে দিয়ে সারসের মতো পা ফেলে ফেলে যখন হালকা গরিমার ভাব নিয়ে হেঁটে যেতেন তিনি, আমার মনে হতো, এই বুঝি বা ডানা মেলে দেবেন, উড়ে যাবেন এই ইঁট কাঠ পাথরের চৌহদ্দি ছেড়ে l আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতাম l

বোরিং জীবন কেন? বলছি l বিয়ের পর, সহসা পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছিলো l বোথ বোন ফ্র্যাকচার l ছেড়ে দিতে হয়েছিল ওয়াই ডাবলু সি এর চাকরি l ওই অবস্থায় টগবগে আহুজাপিসির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন মৃদু ঈর্ষার সবুজ সাপ, এক আধটা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতো, টের পেতাম l ছাড়া পাবার জন্যে মাথা কুটে মরতাম l চোখের সামনে দিয়ে জীবন বয়ে চলতো আপন খেয়ালে l

তারপর … কেটে গেলো দীর্ঘ অনেক বছর l জীবনের ওঠাপড়ার ভেতর দিয়ে আহুজা পিসিরা হারিয়ে গেলো কেমন করে l এল নাইনরা হারিয়ে গেলো l শুরু হয়ে গেল, এক চরম ব্যস্ততার জীবনে ; সকাল সাড়ে আটটায় ব্যালকনিতে হাজিরা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলো কবেই l মাঝে মধ্যে, রাস্তা ঘাটে, আহুজা পিসির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, হাসি বিনিময় ছাড়া আর কিছু মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেনি কোনোদিন l জীবনের রোলার কোস্টারে উঠে পড়েছি l সে’খান থেকে মুক্তি নেই l অন্যকিছুর দিকে তাকানোর সময়ই নেই l আহুজাপিসিরা কিন্তু রয়েই গেলো আবহ জুড়ে l খুঁজে নিলেই হতো, কিন্তু খোঁজা হয়ে ওঠেনি l অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার কথা মনেই আসেনি হয়তো l

এখন সময়কাল আগের চেয়ে ভিন্ন l নিজের অফিস, ছেলের পড়াশোনা কাটিয়ে উঠে একটু অবকাশ মিলেছে l হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাই ভাবার সময়ে এসেছে, ফিরে দেখার সময় এসেছে l মানবীজীবনে ব্যালকনির ভূমিকা টের পেয়ে যাই যখন মিঠে রোদ্দুরে বসে অবগাহন করি অন্তরে l এই বয়েসে পৌঁছে, যে কোনো নারীর কোমরে, পিঠে ব্যথা নাছোড় করোনা-ওমিক্রনদের মতোই নিত্যসঙ্গী l যা হোক, তবু শরীরটাকে সচল রাখতেই হয় l মাঝে মধ্যে বাইরে বেরোতে হয় l সেদিন বাজার সেরে ফিরছি, দেখি সেই আহুজা পিসি l একটা স্ট্রলি ঠেলে ঠেলে বাজার থেকে ফিরছেন l চলছিলেন গুটগুটিয়ে, কিন্তু মুশকিল হলো ফুটপাথের কাছে এসেই l স্ট্রলি ব্যাগ তুলতে পারছেন না ফুটপাথে কিছুতেই l আমরা হাত খালি, সঙ্গে মুটেদাদা, তাই ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম, মে আই হেল্প ইউ l মৃদু হেসে আহুজা পিসি অভয় মুদ্রা দেখালেন, বললেন, থ্যাঙ্কস, বাট আই থিঙ্ক আই কেন ম্যানেজ l

আমি মনে মনে তাই চেয়েছিলাম l উনি যেন পারেন l পারলেন, একটু বেশি কষ্ট করেই, কিছু পরে l বিজয়গর্ব অনুভব করলাম l আবার টুকটুক করে হাঁটতে লাগলেন ফুটপাথ ধরে l একটু নুইয়েছেন যদিও, চলছেন খুব ধীরে, তবু দূর থেকে চেনা কেউ দেখলেই বলে দেবে, ওই আহুজা পিসি l

কিছু মানুষ কেমন একই রকম থেকে যান, চিরদিন l দীর্ঘ, ঋজু , শাল্মলী তরুর মতন l
আর তখনিই আমাদের এতদিনের আহুজা পিসির একটি সুন্দর, নতুন নামকরণ করে ফেললাম মনে মনে – “শাল্মলী” l

দেখলাম, পথচলতি যত মেয়ে শাল্মলী হয়ে উঠছে ক্রমশ l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ছবি – আন্তর্জাল

আনন্দ

নবান্নের ভোগে যেবার প্রথম কিটস এর Ode to Autumn কবিতার গন্ধ পেলাম, বুঝলাম, আমি বড়ো হয়েছি l বুঝতে শিখলাম, যে চাষী মানুষটি ও তার বৌ কণা কণা সোনালী ধান যত্ন করে ঝেড়ে বেছে, সেদ্ধ করে চাল তৈরী করেছে, তাদের সবুজ প্রেমযাপনের কথা l পাকা ফলগুলো এমন করে না পাকলে ওই স্বাদ, গন্ধ আসে ? তখন মনে পড়ে গেলো, মেয়েবেলার সেই কোম্পানির বাগানের পাকা কাঁকড়ি, লাল সবুজ টমেটো আর টুসটুসে বুনো কুলের কথা l সেই সব স্বাদ একত্রিত হয়ে মাথার মধ্যে এক ভোঁ ভোঁ আনন্দের সুখযাপন এনে দিতে লাগলো l আর বুড়ি ঠাম্মির সেই আদুরে হাতের নবান্ন মাখা, সেই সুখস্পর্শ না থাকলে বুঝি নবান্ন ভোগ হয়ে ওঠে না, চাল কলা ফলের মন্ডই থেকে যায় l এতো স্নেহ, এতো ভালোবাসা পৃথিবীতে l আর এ সবের মধ্যে থেকে যে অপরূপ আনন্দ সঞ্জাত হয়, তার অপর নাম: “পরমানন্দ” যেখানে সৎ, চিৎ, আনন্দের মূর্ত প্রকাশ l

ভালো বাসার দিনকাল – নবান্নের গান

একশো তিন নম্বর বাড়িটাতে বারো মাসে চব্বিশ পার্বণ l আর সে সবই মায়ের বুড়ি ঠাম্মির কল্যাণে l দীপান্বিতার লক্ষ্মীপুজো শেষ হতে না হতেই এসে পড়ে নবান্নর জোগাড় l সে হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার রে বাপু l ওই একটুকু পুজোপালিকে ঘিরেও l সপ্তাহ ধরে চাল কোটা হতে থাকবে হুড়মুড়িয়ে l কুঞ্জ মাসি, যমুনার মা, বুড়ো মন্মথ সব্বাই সামিল হয়ে পড়বে সেই আনন্দযজ্ঞে l সবার নিমন্ত্রণ l কাক পক্ষী সব্বার l স্বর্গগত পূর্বপুরুষরা এই তো ফিরে গেছেন মর্ত্য ছেড়ে আকাশ পিদিমের সঙ্গে সঙ্গে হুশ হাউইয়ের আলোর পথ ধরে l ওমা এর মধ্যেই তেনাদের আবার ডাকাডাকি করে নবান্নের সেই অমৃতোপম চাল মাখা না খাওয়ালে কি চলে! সে এক “কাকবলী” উৎসব বই কি l কোত্থেকে এক কাক ভূষণ্ডী এসে, ঘরের ছেলেটির মতো সোনাহেন মুখ করে, কপকপ চাল মাখা খেয়ে নেয়, দেখো l যমুনার মা চোখ গোল গোল করে বলতে ছাড়ে? “ওগো ওকে আমি চিনেছি গো, ও যে ছোট কত্তা বাবু গো, এই তো রাজ্যির তেষ্টা নিয়ে গেলো বাপু, গত বোশেখে?” কুঞ্জ মাসি যোগান দেয়, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, ওই তিনি এয়েচেন কাকপক্ষীর বেশ ধরে l আহা কতদিনের উপোসী গো l” কি কান্ড, রেফারেন্স আমার দাদুর ছোটকা l সে তাঁর গপ্পো আর একদিন না হয় বলা যাবে l

বোঝো কান্ড l এমন সুখের উৎসব l “রাঁধুনি পাগল” চালের গন্ধে কিনা বাড়ি শুদ্ধু সবার নবান্ন খাবার ক্ষুধা বেড়ে ওঠে l এর মধ্যে ওই সব অবান্তর কথা শুনে আমাদের পেট গুড় গুড় করতে থাকে l

চাল ভিজিয়ে কুটে মসৃণ করে বেটে নিয়ে, এক তাল আদা বাটা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে তারই মধ্যে আগে থেকেই l আদার গন্ধ যেন অটুট থাকে l এর পর তার মধ্যে পড়েছে, দিম্মির হাতে কুচি কুচি করে কাটা ফল ফলারি l মটর শুঁটি, আপেল, কলা, ডালিম, পেয়ারা, কমলালেবু, আরো কত কী কী নতুন ফল আর সব শেষে মোলায়েম করে বাটা নারকোল আর নতুন গুড় l এর পর জল দিয়ে মাখা হয়েছে সেই চমৎকার নবান্নর মিশ্রণ l যে কোনো ফ্রুট পুডিংকে কলা দেখতে পারে ওই নবান্নের ভোগ l কিছুটা ভোগ নিবেদিত হয়, গৃহদেবীকেও l আমরাও বুভুক্ষু পাখি সব, কলাপাতা পেতে বসে থাকি বিরাট  দেউড়িতে l যে যত পারো খাও l “ভাত না খেলে নেই,” দিম্মি বলে, “মুখ হাত পা ধুয়ে গিয়ে লেপ বালাপোশ গায়ে চাপিয়ে দুপুরে-ঘুম দাও দিকিন, হুড়োদস্যি না করে l”

নবান্ন খেয়ে যখন সবার মন খুশ হয়ে থাকে সন্ধ্যে পর্যন্ত, তখন তো ছাদের রান্নাঘরে, ঠাকুরঘরে সুখ প্রদীপ জ্বেলে রেখে, তালা পড়ে গেছে l কাক ভূষণ্ডী উড়ে গেছে কোথায় l অনুভবে বুঝি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা নবান্ন খেয়ে খুশি হয়ে আবার ধ্যানে বসেছেন নিজ নিজ লোকে l আর আমরা সেই একশো তিন নম্বর বাড়ির বারো মাসে চব্বিশ পার্বণের আর এক পার্বণের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে কখন সুখের ঘুম গেছি l ঘুমঘোরে  কানে এসেছে দিম্মির ঘুম পাড়ানিয়া গানের কলি – নবান্নের গান l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

অপেক্ষা 


ভিটেটুক আমাকে দুরে যেতে দেয় না l কেবল হাতছানি দিয়ে ডাকে l ওরে আয় আয় আয় l সেই ঝিলমিলে চেনা সুর, ছেলেবেলায় দয়াল ঠাকুরের গলায় শোনা গানের মত l আমারে এমন ফেলে যাস নে রে তুই, বলে ভিটেমাটি l সবাই চলে গেল দেখ, ওই তো খেয়াঘাটে নাও বাঁধা, পারানির কড়ি ফেলে ওঠো আর চলে যাও সেই উদ্ধারণপুরের ঘাটে l সেখানে জেবন নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে আছে সে, তোমারই অপেক্ষায় l বাড়ি বলে চলে সাতকাহন আর আমি আমার লজঝরে হাড় গোড় গুলিকে একসাথে গুছিয়ে নিয়ে পুকুরপাড়ের ভাঙা দোরের আগল দিতে উঠি আজকের মত l আজও এলো নে হরিয়াল, ময়না, তিতির, ওদের ছেলেমেয়েরা l 


পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, চক্ষু মেলে মেলে, রাত জেগে জেগে, কান্না কেঁদে কেঁদে আমার চক্ষু ঝাপসা হয়ে এলো ওই l খেয়াপার, আনন্দী নদী, মাদার গাছ, মনসা মন্দির, আর কিছু ঠাহর করতে পারি নে l টেমিতে ফোঁটাটুক তেল নেই যে আলো জ্বালবো l আঁধার করে আসে চারিভিত l অথচ এককালে এই দাওয়াটুকু জুড়ে কি দবদবা ছিল বল দিনি l তিনি হুঁকা টানতেন এক ধারে বসে আর গান ধরতেন ঝাড়া গলাতে – ও দয়াল রে … বিটিছেলেরা ঢেঁকিতে পাড় দিতে আসতো এই ধারে l ‘রাঁধুনি পাগল’ চালের ভাতের গন্ধ ছুটতো উঠান জুড়ে, আর সেই চালের ঘ্রাণে কর্তার পেট ডেকে উঠতো, কখন এসে পিঁড়িখান পেড়ে ভাত চাইবে l তাঁত চলত টাকুর মাকুর টাকুর মাকুর টাকুর মাকুর l কত রঙ ছিল, কত্ত যে বন্ন ছিল সে দিনগুলোতে l এক একেকটা দিন যেন হাতে করে তাঁতে বোনা, আদর মাখা শাড়ি l


দিনের আলো যেই নারকেল গাছের পাতায় এসে লাগত, অমনি উনি ব্যস্ত হয়ে বলত, অ বড় বউ, টেমি জ্বলবে না l শাঁখে ফু দিও না কেন l সুয্যি পাটে বসলেন যে l আজ সুয্যি কখন পাটে গেলেন কে জানে l নারকেল গাছটা কে বাণ মেরে দিল গা  l আর তার পাতায় রোদ পড়ে ঝিকঝিক করে না যে l আমারও চক্ষুর আলো নিবে গেছে l যেইটুক আছে, তাতে শিরা ওঠা হাত পা গুলান দেখতে পাই শুধু l মানষের জেবনে অপিক্ষের কি শেষ আছে গো l রাত আসে l ঝুমঝুমে নিজ্ঝুম রাত ! যেন সব কালিটুকু ঢেলে দিয়ে যায় এই দাওয়ায় l তখন নতুন বউ … এমনি ঝিমঝিমে রাতে, হঠাত দপ করে কিছু শুনলে কেমন ঘুমের চটকা ভেঙ্গে উঠে পড়তুম আর পাশে ওই লম্বা চওড়া মানুষটের পিঠে মুখ গুঁজে আড়ষ্ট হয়ে ভয়ে জুবজুবে হয়ে থাকতুম l আবার কোনদিন উনি বুঝতে পেরে এপাশ ফিরে আমাকে বুকে টেনে নিত l শান্তি ! মায়ের কোলে শিশুটির মত আমি কেমন নিশ্চিন্দি ঘুম যেতুম শেষ রাত্তিরে l আর এখন হঠাত কখন তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুময়ে পড়ি, কিছুটি বুঝি না l ঘুম ভাঙে কাক চড়ুইয়ের ডাকে l 


দিন আসলে একটা ভালো হয়, অপিক্ষেটা ফিরে ফিরে আসে তার সঙ্গে সঙ্গে l দোর খুলে রাখি, আজ যদি কেউ আসে l তিতির, হরিয়াল কিম্বা ময়না l যদি আসে, যদি এসে পড়ে l যদি ওদের মনে পড়ে মাকে l রক্ষেকালীর মন্দিরের পুরুত ছেলেটি দয়া করে  মায়ের পেসাদ একবেলা দে যায় l প্রাণধারণের জন্যে তাই যথেষ্ট আমার l এই হাত পা গুলো তাই চলে এখনো l না হলে রোজ দরজা খুলবে কেমনে? যদি ওরা এসে দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়, যদি ভাবে, ওদের মা মরে গেছে, আর কেউ নাই এই ভিটেটুকুতে ? ভয় পাই l 


পুরুতকে বলে রাখি, বাবা, ওরা যেদিন আসবে, আর এক থাল পেসাদ দিলেই হবে l ওইটুকু ওরা খাবে ‘খন l আমার না খেলেও চলে, আর তো তারপর হাত পায়ের জোর লাগবে না এরপর l একবার, ওরা এসে গেলে ! আর অপেক্ষা করতে লাগবে না l হাতপাগুলান জড়ো করে আর দরজা খুলতে লাগবে না আমার l তখন আমার খাওয়াই বা কি, না খাওয়াই বা কি l 


অপর্ণা গাঙ্গুলী

ঘরভাঙানে জোছনা 


আজ, ঠিক আজ যেমন জোছনা উঠেছে আকাশে, ঠিক অমন জোছনায় আমাদের মেজ বউ কেমন হয়ে যায়  যেন l কান পেতে থাকে l এই পুরনো বাড়িটাতে আনাচে কানাচে গলিতেঘুঁজিতে, যদি শুনতে পায়, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘোড়ার খুরের শব্দ l সে বলেছিল, সে আসবে l অন্তত চিঠিটাতে তো তাই বলা ছিল l কোথায় যেন পড়েছিল, মেজ বউ , নাহ এখন আর ঠিক মনে পড়ে না, এমন গৃহত্যাগী এক জোছনার কথা l আজ যেন ঠিক তেমন l ওই তো ছাদ বেয়ে  চুইঁয়ে চুইঁয়ে পড়ছে তাল তাল রুপোলী আলো আর নেমে আসছে শিঁড়ি বেয়ে ভেতরের বারান্দাতে, তার ঘরে, সব ঘরে, আর নিচের ঠাকুর দালানে l এ বাড়ির বুড়ো কাজের মানুষ মন্মথ অনেক দিন তাকে বলেছে, “বউমণি যেদিন ঘরভাঙানে, হতচ্ছাড়া এক জোছনা উঠবে, সেদিন একজন বাড়ি ছাড়বে, কেউ তাকে ধরে রাখতে পারবে না কো l তুমি দেখে নিও l এই বাড়িতে এমনই তো হয়ে এসেছে চিরটা কাল l এ বাড়িতে লক্ষীদেবী যদ্দিন বাঁধা ছিল, এ সব অনাসৃষ্টি ছিল না গো,” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে মন্মথ l তারপরেই তার ঘোলাটে চোখ বড় বড় করে, তর্জনী উঁচিয়ে বলে, “ওই শোনো বন্দিনী লক্ষ্মীর কান্না l” বলা বাহুল্য, এ সবে মেজবৌয়ের মন নেই l দিদিশাশুড়ি বলেন, মন্মন্থর মাথা গেছে, ও নাকি আফিং খায় আর উল্টোপাল্টা বকে l তবে নিশুত রাতে ছুম ছুম আওয়াজ পায়নি কেউ, তা নয় l পেয়েছিল বড় বউ l তার শাশুড়ি মারা যাবার পর পরই l ছেলেকে কাছে করে বাগিয়ে শুয়েছে বড় বউ, ভয়ে ময়ে l স্বামীকে বললে উনি রাগ করবেন, তাই নীরব থেকেছে l ছয় মাসের মধ্যে কোত্থেকে কি অনর্থ, বড় ছেলে ড্যাং ড্যাং করে মায়ের পিছু পিছু যাত্রা করলো l 


মন্মথ তার আগেআগেই এইসব পাগলামি করেছিল আবারও l “অই দ্যাখো মা, কেমন ঘর পালানে জোছনা দিয়েছে দেখো তুমি l” বুড়ি থুত্থুরি দিদি শাশুড়ি বড় বৌয়ের শোকে পাথর, ঝামটা মেরে বলেন, “থাম দিকিন বাপু, আমি মরছি আমার শোক বুকে নিয়ে আর তোর যত আকথা কুকথা এখন, যাহ দূর হ l” মন্মথ মুখে কুলুপ আঁটে l এর পর থেকে জোছনা উঠলে, কি জানি কেন, মেজ বউর ভয় ধরে l সে এমনি খুব যে ডাকাবুকো তা তো নয় l তবে অই, জোছনা ভালবাসে বলেই বিয়ের পর পর একবার ছাদে শাশুড়ির ঘরে উঠেছিল সন্ধ্যেকালে l তখন ভরা যৌবন, নতুন বিয়ের কনে l শাশুড়ি রোগে শয্যাশায়ী l ঘরে বসে কথা বলতে বলতে, হঠাত কি হলো, উঠে বসেন শাশুড়ি, খিল খিল করে হাসতে হাসতে বললেন, “ভেবেছ মরে যাব? এত্ত তাড়াতাড়ি? কেন গা, আজ ঘর পালানে জোছনা উঠেছে বলে? আর তুমি আমার সব শাড়ি গহনা, হড়প করবে কেমন? ওটি হচ্ছে না, আমি আমার অই আলমারির সামনে প্রেতিনী হয়ে এই এমনি করে দাঁড়িয়ে থাকব বুঝলে?” মেজ বউ আকাশ থেকে পড়েছিল, এ সব তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি, সে ছাদে জোছনা পোহাতেই এসেছিল l ভেবেছিল মায়ের ঘরে কিছুক্ষণ বসেই নিচে নেমে যাবে l এ কি ধরনের রসিকতা? সুশিক্ষিতা মেজ বউ স্বামীর মায়ের এই প্রচন্ড মেয়েলিপনাকে ভয়ংকর ঘৃণা করেছিল, সেই মুহুর্তে l ২১ বছরের মেয়েটি উঠে গিয়েছিল এক পিঠ জোছনা নিয়ে নিচে নিজের ঘরে l কিছু বলেনি কাউকেই l তবে জোছনময়ী কোনো সন্ধ্যেরাতে আলো মাখতে আর ছাদে ওঠেনি কখনও, শাশুড়ি মা যদ্দিন এবাড়িতে ছিলেন l 


এখন তারাই সবাই গৃহ্যত্যাগী l পড়ে আছে মেজ বউ, বাড়ি আগলেই l বাড়িটা তাকে আষ্টে পৃষ্টে বেঁধেছে l মন্মথর লক্ষ্মীদেবীর দেখা পায়নি বটে, তবে ভরভরন্ত এই বাড়িটাতে তাঁর কৃপা অনুভব করেছে অনুক্ষণ l আজকাল এমন ঘর ভোলানে জোছনা রাতে, ছাদে উঠে মায়ের পাগলি পিসির মত জোছনা মাখতে ভালবাসে মেজ বউ l চুল এলিয়ে দেয় ছাদে l আর ঠিক তক্ষনি লক্ষ্মী দেবীর বাহনটিও কেমন চিলে কোঠার কার্ণিশে এসে বসে দেখো l গোল গোল চোখ পাকিয়ে পাগলি মেজ বৌয়ের ছাদে ঘুরে ঘুরে নাচ দেখে l মুঠো মুঠো জোছনা খায় মেজ বউ ; জোছনার রূপটান নেয় গায়ে পায়ে l কখনও কই ভাবে না তো, পাশের বাড়ির বউটা যদি ছাদে ওঠে হঠাত ,ভাববে কি! ও হরি, ও কি আর ভাববে? ও যে কবে মরে প্রেতিনী হয়ে গেছে গো l হাসতে থাকে মেজ আর সারা বাড়িতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সেই হা হা হা হা হা হা  হাসির লহরী l ওরও যে মেজর হাল, কিসসু পেল না, চলে গেল l  মেজ বৌয়ের ছেলে মেয়েরা পড়তে গেছে বাইরে ; আর বড় বউ সেই একতলায়, সুতরাং এখন মেজকে পায় কে? সে আর জোছনা, জোছনা আর সে, দুই সখী গলা জড়াজড়ি করে পান করে একে অপরকে l কিন্তু মাঝে মাঝে কান খাড়া রাখে বই কি, সেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আসে কিনা, কে যেন বলেছিল আসবে? কে যেন, কে যেন … ঠিক মনে পড়ে না মেজ বৌয়ের l ঘর ছাড়ানে জোছনা যে আজ গো ; আজ পালালেই বেশ হবে তার সঙ্গে ঘোড়ায় চেপে ; সেই মেজবৌয়ের স্বপ্নের পুরুষ, শাদা পোশাকের “নেই মানুষ” l যদি আসে  l 


যেবার কর্তা ঘর ছাড়লেন অন্য কার হাত ধরে, সেদিনও ঠিক এমনি জ্যোছনা ছিল আকাশে হয়ত, মনে পড়ে না এখন l তবে সেদিন বুঝেছিল মেজ, ওর পায়ের বেড়ি কেটেছে l অমন বাড়া ভাত, অমন আদরআত্ম্যিযত্ন, সব কিনা ফেলে দিয়ে যেতে পারলেন তিনি l একবারও মেজকে ভাবলে না l তার ভাত খাওয়া দেখতে দেখতে নিজের পেট ভরে যেত বৌয়ের – “আজ মাছটা ভালো হয়েছে, আরও একটু দিই l”

“নাহ, এর থেকে অমুক অনেক ভালো রাঁধে, আর লাগবে না মেজ বউ !”

চোখের জল পাথর হয়ে জমে দিনে দিনে,  তবু আশা তো কমে না l আবার মানুষ, আবার ভাত বাড়া, আবার পা টিপে দেওয়ার সাধ ? কিসের তোর এত নোলা রে মুখপুড়ি l কেন তুই কাকপক্ষীকে খাইয়ে সুখী হোস নে কেন রে, এত পুড়ে পুড়ে খাক হবার শখ তোর ? এত্ত? এত্ত এত্ত? কখন নিজের অজান্তে মাথা ঠোকে দেয়ালে মেজ বউ l ঘর ছাড়ানে জোছনাতে ছাদ ভিজে যায় l আর লাল হয়ে ভিজে যায় তার কপাল, বুক l হায়রে, এক ফোঁটা সিঁদুরের, সোহাগের আশ বুঝি এইভাবে মেটে গা l মেজ বউ ছাদের দরজায় কুলুপ তোলে, নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে, হা ক্লান্ত হয়ে l আজ বুঝি তবে গৃহত্যাগী জোছনা তেমন ওঠে নি ! উঠলে ঠিক সে আসতো, আসতই ….
দেয়ালে টিকটিকিটা বলে ঠিক ঠিক … আর একবার আশায় বুক বাঁধে মেজ বউ, অপেক্ষা শুরু হয়ে আরো এক পৌর্ণমাসীর ঘর পালানে জ্যোছনার l স্বপ্ন দেখে, শিঁড়িতে বাঁধ ভাঙা জ্যোৎস্না, কাঁচের জানলা দিয়ে সবটুকু সিঁড়ি, উঠোন ভাসিয়ে দিয়েছে আর দরজায় দাঁড়িয়ে অশ্বারোহী পুরুষ! মেজকে নিতে এসেছে  l 


কিন্তু কেন জানি না, স্বপ্নটা শেষ হয় না মেজর কখনোই …. স্বপ্ন ভেঙে যায় l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ছবি: রাজা রবিবর্মা

চণ্ডীর পুকুর

কলকাতা থেকে গ্রামে এলে ছুটে চলে যাই সেই প্রাচীনা পুষ্করিণীর পারে l এই চণ্ডীর পুকুরের পুরোনো জলে মায়ের বহুদিনের বেনারসীর গন্ধ l গাছের ফাঁকে প্রবীণা রোদ্দুরের ঝিকাঝিল্লি ওই জলে l যেন হীরে-জরির আল্পনা l এই পুকুরের ধারটি, একেবারে আমার মায়ের মতো l এতো স্নিগ্ধ সংরাগ আমার অন্য কোথাও হয়না l তাই দিনরাত পুষ্করিণীর জলে পা ডুবিয়ে বসেই থাকি l রুপোলী মাছেরা আমার পায়ের শুকনো মাংস কুরে কুরে খায় l মামারবাড়ির আহ্লাদ l নিখরচায় ‘পেডিকিওর’ l আরাম লাগে l শহুরে যত মলিনতা ধুয়ে মুছে দেয়  l 

পুষ্করিণীর পাড়ে ওই দিদিমশাই গাছ l বয়স জানা নেই, তবে মায়ের দিদিমায়ের মতোই হবে l আমি ওই গাছের কাছে গেলেই মায়ের গন্ধ পাই l এই গন্ধ আমার জন্মান্তরের চেনা, আমার মায়ের, আমার দিদিমায়ের গায়ের গন্ধ l আমার চেতনায় জড়িয়ে থাকে চিরকাল l দেখি গাছের অন্য একটি ডালে পাতার বোঁটা থেকে ঘন সাদা বিন্দু বিন্দু ‘কলোস্ট্রাম’ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে টুপ্ টুপ্ l আর ওই নতুন পাতার জন্ম দেওয়া সদ্য প্রসূতি গাছের কোষে কোষে, গর্ভাধারে, পা বেয়ে, শিকড় বেয়ে ওঠে এক অস্বস্তিকর ব্যথা l শিশুকে স্তন্যপান করাবার সময়ে মায়ের যে নিদারুণ তৃষ্ণার্তি l তিয়াসী গাছ আকাশের বুক ফুঁড়ে জল চাইছে শুধু l ওর এক বুক তৃষ্ণার জল l ওমা, দেখতে দেখতে মেঘ ঘনিয়ে আসে l

ডাকাত মেঘদের দেখেই আমার মাথায় প্রবল দুষ্টুবুদ্ধি চাপে l জটিবুড়ির জটার মতো ওই ঝুড়ি নেমেছে ওর গা থেকে l আমি ঝুড়ি ধরে দোল খাই l হেঁইয়ো হেঁইয়ো হেঁইয়ো l পা দুটো জোড় করে তুলে দিই আকাশের বুকে l আর আমাকে পায় কে l মুক্তি l মুক্তি !! পিঠের ডানা দুটো অমনি চুলবুলিয়ে ওঠে, মা চন্ডীর সখীদের পিঠের ডানার মতো l  এ দিকটাতে আসা বারণ, বিশেষ করে সন্ধ্যেবেলাতে l মা চন্ডীর থান এ, আর ওই যে চন্ডীর পুকুর l মায়ের দিদিমশাইয়ের কাছেই শোনা, গভীর রাতে ওই পুকুর পারে, ওই গাছকে ঘিরে ঘিরে কারা নাচে l চন্ডীর অষ্টসখীরা l তখন যদি কেউ আড়াল থেকেও ওদের দেখে, তো চোখ অন্ধ হয়ে যায় l আমি জানি আমি দেখলেও চোখ অন্ধ হবে না l কারণ আমি দেখবো মানসচক্ষে, সে এখানটাতে না এলেও দেখা যায় l 

তবে, মানুষের মন l তাই সবাই সন্ধ্যে থাকতেই ঘরে দোর দেয়, এদিকে পা বাড়ায় না l গাছের নিচে বড়ো একখানা শিলা, চণ্ডীমুর্তি l সিঁদুর লেপা মূর্তিতে রোজ পুজো পড়ে রাশি রাশি l বেনারসী চেলি পরলে ওই শীলাবতী হয়ে ওঠেন মনোমোহিনী দেবী l সন্তান লাভের আশায় মেয়েরা দলে দলে হত্যে দেয়, দণ্ডী কাটে, সেই পুকুর থেকে এই থানে l সন্তান হবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় l গাছের গায়ে অজস্র ঢিল বাঁধা l অসংখ্য টিউমারের মতো হৃদয়ের আর্তি আর কান্না জড়ানো প্রার্থনার স্মারক সে সব !  যুগে যুগে মেয়েদের অপমান আর লজ্জার স্বাক্ষর বহন করে চলে l যেন মা হবার সবটাই ওদের উপর l ওদের স্বামীরা ঝপ করে ওদের ত্যাগ করে অন্য বিয়ে করে নিয়ে আসে l ভাগ্যের ফেরে তাকেও দণ্ডী কাটতে হয় l তবু অভাগা স্বামী তার নিজের কোনো দোষ দেখে না l 

দিন দুপুরে এই চৌহদ্দীতে ছাগল, গরু বাঁধা থাকে l আর থাকি আমি l মঞ্জরী l পিঠে এক ঢাল কৃষ্ণ ভ্রমর চুল ফেলে এ ঝুড়ি থেকে ওই ঝুড়ি দোল খাই  l কখনো ঝপাং করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ি জলে l  পৃথিবীর যত রূপ রস গন্ধ স্পর্শ চেটেপুটে নিই এক লহমায় l আকাশের দিকে দু’ হাত তুলে বলি, আমাকে পূর্ণ করো, পুণ্য করো l শুধু মনে হয় – আহা এই সকালে আমি বেঁচে আছি, প্রাণ ভরে আছে চতুর্দিকে … এর থেকে ভালো আর কি বা হতে পারে l দু’টি হাতের ফেরে জড়িয়ে ধরি আকাশকে, সমস্ত পৃথিবীটাকে l আর সবাইয়ের জন্য আনন্দ চেয়ে নিই একঢাল l তখন কেমন সবেতে প্রাণ জেগে ওঠে l এমনকি ওই শিলা পাথরটিতেও l ঠিক এই সময়টিতেই আমি একেবারে নেই হয়ে যাই, মিশে যাই প্রকৃতিতে l বুঝতে পারি,  বিন্দু বিন্দু মধুক্ষরণ হয় সবদিকে l 

বিভ্রম নয় !

মায়া নয় ! 

প্রকৃতি তার নিয়মে চলে l তার ওই অদ্ভুত নিয়মেই সে ঋতুমতী হয়, রজঃস্বলা হয়, গর্ভবতী হয়ে ফুলে ফলে ভরে ওঠে l বাসুদেবএর বৌ পোয়াতি হয়েছে l মা চণ্ডী কি করবেন l হারুর বৌয়ের তিন মাসে গর্ভপাত হয়ে গেলো l মা তাতেই বা করবেন কী ? মাকে কেউ পুজো দেয়, কেউ গঞ্জনা l সর্বসহিষ্ণু শিলা নির্বিকার, নিরুত্তাপ l প্রকৃতির নিয়ম মেনে সব কিছু ঘটে যায়, ঘটবে l শুধু মানুষ বুঝেও বুঝবে না l 

আমি মাটির বুকে কান পেতে থাকি l মেদিনীর বুকের ওমে জারিত হই আমি l দু হাতের পাতায় কান চাপা দিই l শুনতে পাই, অতি দূর থেকে গুম গুম গুম গুম … ভেসে আসে সেই একমাত্র প্রণব ধ্বনি, – ওম, ওম, ওম l 

আর তারপরে l 

তুরীয় নৈঃশব্দ্য l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ভালো বাসার দিনকাল – উপহার

আজ কাক্কেশ্বর এসে ক ক করে কথা বলে উঠতেই দু’দিন আগে আন্তর্জালে পড়া একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল l পশু পাখি গাছপালা ভালোবাসি, তাই এক প্রিয় বন্ধু ওই খবরটি পাঠিয়েছিলেন l ধন্যবাদ তাঁকে l গপ্পটি চমৎকার, যদিও জানি পশুপাখিদের ভালোবাসা অপরিসীম তাই অবাক হইনি খুব l ঘটনাটি ২০১৯এ ২৪শে মে টুইটার করেছিলেন আমেরিকার এক পাখি প্রেমী এবং সংগীতজ্ঞ মানুষ, স্টুয়ার্ট ড্যালকুইস্ট l তিনি এবং তাঁর সহৃদয় পরিবার এক কাক, তার কাকিনী ও তার দুই বাচ্চাকে বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত খাবারদাবার খাওয়াতেন l কৃতজ্ঞ সেই কাক পরিবার স্টুয়ার্টের পরিবারকে এক অবাক করা উপহার দিয়ে যায় পরপর দুই দিন ধরে l এলুমিনিয়াম ক্যানের অংশ নিয়ে তার মধ্যে পাইনের শাখা বুনে বুনে কেমন সুদৃশ্য একটি ওয়াল হ্যাংগিং বানিয়েছে ওরা l বাহ্ রে কাক l (ছবিতে বেশ পরিষ্কার সেই উপহার ) এমন সরল, স্বর্তঃহীন ভালোবাসা পৃথিবীতে এখনো আছে, ভাবতে ভালো লাগে l

তা এই লেখা পড়ে মনে হলো অনেকদিন পোষা কাকেশ্বরকে নিয়ে কিছু বলিনি, বলা যাক l কাকেশ্বর সক্কাল সক্কাল এসে পড়লেই চা বিস্কুট সহ দুটো কথাবার্তা হয় l কাকেশ্বর গলাখানি যথাসম্ভব মিহি করে কথা বলে তখন l কা কা নয়, ক ক গুট্টু গুটুর এই সব… যেন এক দলা নাইনিতালের নতুন আলুমাখা খেয়েছে সদ্য l আমিও ওকে সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিতে বসি l আমারও বেশ কাজের কথাগুলি ঝালিয়ে নিই এই ভাবেই l কাক্কেশ্বর বলে, ‘মা, আজকাল তেমন খাবার পাই না, মানুষজন আজকাল আর কিছু ফেলে খায় না  l ওদিকে কাকিনী সারাদিন ডিমে তা দিয়ে বসে থাকে l ওর জন্যেও নিয়ে যেতে হয় l কি করি বলো, আমি তো একাই এখন আর্নিং মেম্বার কি না l” এমনই কিছু মামুলি সাংসারিক কথা হয় l
“তা বটে বাবা l” দুটি বিস্কুট, পাউরুটির টুকরো বেশি দিতে হয় l

তারপর বিস্কুট খেয়ে মুখটুখ মুছে, মতো বিদায় নিয়ে – “মা, এখন আসি” বলে উড়ে যায় সে l দুপুরবেলাতে দেখা দেয় রান্নাঘরের জানালায় l ক্লাসের ফাঁকে দু মিনিটে খেয়ে নিয়ে ওর জন্যে একটু ভাত মাছ রেখে আসি আমি l

ওর বরাদ্দ খাবারে মাঝে মাঝে এসে জোরে করে ভাগ বসায় বকম বুড়ি l একটি গোলা পায়রা l ওর বকর বকরে মেতে থাকে আমার উঠোন l
“কী যে করি, এতো কাজ তত কাজ, কী যে করি, ভেবে মরি, কী করি আজ l” এটাই বকম বুড়ির বক্তব্য সারাদিনে l ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কথাই বলে চলে সে l অন্য ২০-২৫ টি পায়রার খাদ্য গম কিন্তু বকম বুড়ি ভারী অন্য পায়রা কিনা l ও আবার গুগুলের মেটে, চিকেন মাখা ভাত খায় একটু, না হলে কাকেশ্বরের ভাগের মাছ ভাত l ওরা খেয়েদেয়ে উঠোনের শেডের ভেতরে মুখ গুঁজে ঘুমোয় আর না হলে সারাদিন হুম হুম হুম হুম করে “বগরবগর” করে মাতিয়ে রাখে আমার ঘর দুয়ার l এক কালে, যখন ছেলেমেয়ে দুটি ছোট ছিল, ওদের জুঁইবেলি চুপকথারা আমার আঙিনা জুড়ে ফুটে থাকতো l এখন ওদের কলকলানি শুনতে পাই অনুভবে l

বাচ্চা গুগুলএর যেদিন ডিনার পছন্দ হয়, সেও তো তার সবথেকে প্রিয় খেলনা একটি হলদে রঙের মিষ্টি শুঁয়োপোকা এনে আমার নাকের সামনে দোলায় l আমার দিকে তাকিয়ে থাকে l তখন সারমেয়দের এমন আচরণ সম্পর্কে প্রবীণ গুগলের স্মরণাপন্ন হই l পড়ে দেখি, ও’সব নাকি ওদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিদর্শন l ওদের আর কি আছে, ওই একরত্তি খেলনাটিকেই ওরা নিজের বলে মানে কি না? তাই দিয়ে যায় আমাকে l কি মিষ্টি, ভারী অবাক হই l

আজকাল রোজ রোজ ছাদে উঠি সিঁড়ি বেয়ে l জ্ঞানের সিঁড়ি l সকল অজ্ঞানতার পারে সেই ছাদ l প্রকান্ড, বিস্তৃত l ঠাকুর এই অবস্থা করে দিয়েছেন l নাহলে পায়রাদের বাড়ির উঠোনে, খেতে দিলে তাতে বাধাই বা আসবে কেন l আমার মনে মনে হলো, ওরে, এ আমার কুঁড়েমি নিরসনের উপায় l এ সব মহামায়ার লীলাখেলা বই তো নয় l ওই যে আদ্যাশক্তি মূর্তি, যে ঠাকুরের আসনে বিরাজ করছেন, ওই তিনিই এবার বিধান দিয়েছেন l সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ছাদে ওঠ রে মেয়ে l কৃতজ্ঞ হই l অজ্ঞানতার ধাপ পেরিয়ে পেরিয়ে তাই পৌঁছে যাই অখণ্ড অনন্ত চিৎশক্তির আওতায় l পায়রাগুলি যেন এক একটি ঈশ্বর l সাদা, কালো, মেটে, ধোঁয়াটে, ধূসর, নীলবর্ণ l অখণ্ড চৈতন্যশক্তি l কোত্থেকে তারা উড়ে আসে l আমাকে আর ডাকতেও হয় না l ওই যে সিঁড়ি ভেঙে উঠেছি নিজের খেয়ালে l অন্ধকার পেরিয়ে এক আকাশ আলোর দিকে l পায়রাগুলো কেমন অনন্ত চৈতন্য শক্তির মতো খেলে বেড়ায়, গমের দানা খায় জীবন থেকে খুঁটে খুঁটে l প্রানভরে ওদের দেখি l তবে? শুধু ঐটুকু … ওই সিঁড়ির ধাপে ধাপে উত্তরণ l
অথচ এই ছাদে ওঠাই কতদিন যে হয়নি l তাকিয়ে দেখি, শরৎ শেষের দুপুরে আলোতে চৈতন্য জরে রয়েছে চারিদিকে l পায়রা, কাক, চড়ুই, এই দেহ, ছাদ, সিঁড়ি দেয়াল, কাঠ, আকাশ, বাতাস সবখানে, সব জায়গায় তাঁরই প্রকাশ l আর সবচেয়ে অবাক লাগে, দেখি, বিন্দু বিন্দু মধুক্ষরণ হচ্ছে অবিরত, অনন্ত, নিরন্তর l
নমো মধু: l

পুনশ্চ:
বকম বুড়ি একটি ঝকঝকে পালক ফেলে গেছে আজ l উপহার l

অপর্ণা গাঙ্গুলী 

বোন ফোঁটা

ছোটবেলাতে বড্ড ভাইয়ের জন্য প্রাণ আনচান করত l তখন সদ্য সদ্য অজন্তার ভাই হয়েছে, এইটুকু ছোট্ট পিটপিটে-চোখ বড্ড মিষ্টি l  শুধু অজন্তার মা এখনো ওকে অজন্তার কোলে দেন না l  বলেন, পড়ে যাবে ভাই l  আমি চাওয়াতে আমাকেও এক কথাই বলেছেন l  অথচ আমাদের খুব ইচ্ছে হয় আমরা ওকে কোলে নিয়ে দোল্লা চড়াই, মেরী গো রাউন্ড এ পাক খাওয়াই l  এই সব ইচ্ছেগুলো একদিন শাবি মাসি কে বলেছি কি না বলেছি, শাবি মাসি আমাকে এক ভয়ানক খপর দিল l  অমা ই কি মেয়ে গো, তাও জানো না? তোমার তো ভাই তৈরী হচ্ছে তোমার মায়ের পেটে!

আমি বিভত্স রকমের চমকে গেলুম l  ভাই? তাও মায়ের পেটের ভেতর? কোথায় দোকানে যাব গিয়ে সোজা কিনে নিয়ে গট গট করে বাড়ি ফিরব তোয়ালে মুড়িয়ে তা নয় l  এ কি অনাসৃষ্টি কান্ড বাপু l  তা যাক, আমি আর না পেরে মাকেই জিজ্ঞাসা করে বসি মায়ের ভালো মুড্ দেখে l  তখন আমি তিন l  “তা হ্যা মা আমার ভাই নাকি তোমার পেটের মধ্যে তৈরী হচ্ছে l”  আমার মুখ দেখেই হোক বা প্রশ্ন করার ভঙ্গিমাটুকু দেখেই হোক, মা কুলকুল করে হেসে উঠলেন l  বললেন, “তাই বুঝি? তা তোমাকে কে বলল ?” আমি স্রেফ বলে দিলুম “কুলবালা l”  কুলবালার কথা সব্বাই জানে l  সে যে যে আমার পেটএর মধ্যে থাকে আর মাঝে মধ্যে বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গেই খেলা করে l  মা বললেন, সত্যি বল l  আমি বললুম না কিছু l  তবে সত্যি মা কিছুদিন বাদে আমাকে ঠাম্মার কাছে রেখে, দিম্মির বাড়ি চলে গিয়ে থাকতে লাগলো l  ঠাম্মার বাড়িতে থাকতে একা একা মা ছাড়া আমার কিছুতেই ভালো লাগত না l  তবু কি আর করি l  থাকতুম কষ্ট করে l  রোজ রাতে আমার ছেলেমেয়েদের মাথার কাছে নিয়ে শুতুম, মনে পড়ে l  ওদের জন্যে মাথার কাছেই রেখে দিতুম, মাটির সন্দেশ, রসগোল্লা, পান্তুয়া l  ঠাম্মা এইসব দেখে খুব আনন্দ পেতেন l  বলতেন, “ভাই তুই খুব ভালো মা হবি l”  আমি বলতুম, “কি করি বল, ওদের যে মাঝরাত্তিরে খিদে পায়, আহা বাছারা l” আমি কি আর তখন বুঝতাম ছাই l  বলতুম “ভাই হলে ওকেও এইসব খাওয়াব l”

যথাসময়ে বাপি এসে আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেল l  আমার নাকি বোন হয়েছে l  দিম্মি বলল, ভগবান ভুল করে ভাইয়ের জায়গায় বোন পাঠিয়েছে l  কি রকম ভগবান কে জানে l  এমন ভুল ও হয় ? গিয়ে দেখি মন্দ নয়, লাল মত একটা খুদে বাচ্চা, কালো চোখ আর মাথা ভর্তি কালো চুল l  পাশের কটএর টি আরও সুন্দর ছিল, তবে ন্যাড়া l  বাপিকে চুপিচুপি বললুম, চল ওকেই নিযে নিই l  বাপি বলল, ও তো তোমার বোন নয়, এই তোমার নিজের বোন l  নিজের বোনের দিকে তাকালুম l  চোখ বুজে আমার ওয়াকি টকি ডলএর মত ঘুমুচ্ছে l  ধুর, এ কবে বড় হবে আর কবেই বা খেলবে আমার সঙ্গে, তার থেকে ভাই হলে ….  বোন বাড়িতে এসে একটা বেগনি রঙের কাঁথার উপর মায়ের পাশটিতে শুয়ে থাকে l  আমি দেখি আর বড্ড হিংসে হয় l  মা কে বলি, “ওকে তোমার পচ্ছন্দ হয় ?  ওকে ফেলে দিয়ে আমাকে নাও না মা l  ওকে দিম্মিকে দিয়ে দাও l”  মা বলেন “এস তোমার কোলে দিই l”  সাপটে বসে নিলুম তাকে কোলে আর কি আশ্চর্য সে আমার দিকে চোখ মেলে চেয়ে হাসলে l  আমি গলে গেলুম l  সেই থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব l  অটুট l  “আমার বোন, আমার বোন,” ভাবতে ভাবতে ঠাম্মার বাড়ি গেলুম l  আর তারপর থেকেই মা সব ভাই ফোঁটাতে বোনকে ফোঁটা দেওয়ালো, যাতে ভাই ফোঁটা দিতে না পারার কষ্ট না থাকে l  এই তো মামাতো পিসতুতো ভাইদের সঙ্গে আজও সে এসেছিল l  হেসেছিল l আমাকে বড় আদর সম্মান করেছিল চিরদিনের মত l  সারাদুপুরটা আমার সব দু:খু ওর হলো, ওর সব দু:খু আমার l  গলা জড়িয়ে মা বাপির কথা বলতে বলতে কাঁদলুম খানিকটা আবার হো হো করে হাসলুম l 

বড় ভালো, বড় নিবিড় এই বন্ধুত্ব l চিরকালীন l শ্বাশ্বত l মধুর l

বিজ্ঞ ভূত

গভীর রাতে ভয়ঙ্কর রকমের কিচকিচ আওয়াজ শুনে উঠে বসলুম l পুরোনো বাড়ি, এখানে ছুঁচো, ইঁদুর, বাঁদরের উপদ্রব আছে জানি, তাই কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুইছি, ওমা হঠাৎ কানে এলো, “এই রে, মানুষটা উল্টে পড়ে ঘুমুচ্ছে, এই সুযোগে ওর লেখার নোটবুকটা পড়া যায়?’ মাঝরাতে ভাবতে লাগলুম, ওরে এবারে মাথাটাই বুঝি খারাপ হয়ে যাচ্ছে.. ইঁদুরে লেখা পড়ে? এমন তো শুনিনি l যা হোক আর তাই হোক, এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না, এই না ভেবে, পাশ বালিশখানি বাগিয়ে মটকা মেরে পড়ে রইলুম l ঘড়ির টিকটিক কানে আসছে l ওরে বাবা শুনেছিলাম বটে, মাথা গন্ডগোল হলে নাকি ঘড়ির আওয়াজ কানে আসে l কিন্তু না, ওই তো ফিসফিস l “ওরে আটের পাতায় দেখ দিকি, ঐখানেই আমাদের নিয়ে লিখেছিলো যে l” সম্প্রতি আমি একটি নতুন নোটবুক নিয়েছি, এবং তার ষোলো পাতা অবধি লিখেছি বটে, তবে ইঁদুরদের নিয়ে কোনো লেখাই আমি যে সেখানে লিখিনি, সে কথা হলফ করেই বলতে পারি l এমনিতে আমি কাক পক্ষীর ভাষা কিছুটা বুঝতে পারি, তাই আরো শোনবার আশায়, কান পেতে আছি, অমনি শুনি, “ওরা বলছে, এই তো, এই সেই লেখা … এই যে এখানেই তো বলছে, ওরা ভূত বলে ওদের কি ইয়ে থাকতে নেই ?”

ও হরি তবে এরা বুঝি ছুঁচো ইঁদুর নয়? এরা তবে ভূত? এবারে আর না তাকিয়ে পারলুম না গো l মিটমিট করে চোখ তাকিয়ে হালকা নীলাভ নাইট ল্যাম্পের আলোতে দেখি, আমার লেখাপড়ার টেবিলে তিন চার ইঞ্চি উঁচু দুই মূর্তি l তারা আমার এখনকার নতুন জাবদা নোটবুকটির ওপর বসে বসে দুচার লাইন করে পড়ছে আর ব্যাখ্যা করছে l বেশ লাগলো যা হোক, মাথার কাছে রাখা ডার্ক চকলেট সহযোগে এ হেনো মনোরম দৃশ্য উপভোগ করবো কিনা ভাবছি, এমন সময়ে একজন বললো, “হ্যাঁ রে, এ কি আমাদের নিয়ে কোনো রঙ্গ রসিকতা করার উদ্দেশ্যে এমন করে লিখেছে?” ন্যাড়া মাথা ভূতটা মাথা নাড়িয়ে, বিজ্ঞের মতো বললো, “হুম, হলেও হতে পারে l ওরা আজকাল আমাদের নিয়ে বড্ডো রসিকতা করছে বটে l”


“ভাইপো, আসলে কি জানিস, মানুষ আজকাল বড়ো ডেসপারেট হয়ে পড়েছে কিনা l এখন তো ভূত হলেই হওয়া যায় l ঝপাঝপ ভূত হচ্ছে আজকাল, এম এল এ হওয়ার মতোই সহজ l তাই আমাদের যেটুকু মান সম্মান ছিল সব গেছে রে, সব গেছে l “
“যা বলেছো গো কাকা l আজকাল সব ইনস্ট্যান্ট ডালগোনা কফি গো l”
যা হোক, কাকা ভাইপো ভূত হলেও বেশ শিক্ষিত l ফটাফট ইঞ্জিরি বলছে, কথাবার্তাও বেশ যুক্তি সঙ্গত l কি বলে, আমার কিন্তু বেশ ভক্তি শ্রদ্ধাই করতে ইচ্ছে হলো এদের l চকলেট খেলে যদি বুঝতে পারে, তাই আর কিছু না করে এক পাশ ফিরে শুয়ে রইলুম l বেশ খানিকটা তর্জমা, করে দু চারটি বানানের ভুল ধরে, সেই কাকা আর ভাইপো ভূত কিনা শেষকালে জানলার ফাঁক দিয়ে বিদায় নিলো, রাত সোয়া তিনটে নাগাদ l

সকালে উঠে দেখি, নোটবুক আটের পাতাতে খোলা l আর তাতে চাপা দেওয়া রয়েছে আমার ডার্ক চকলেটের বাক্স l ওখানে কি করে গেলো, কিছুতেই ভেবে পাই নি l মনে হলো, যেন দু চারটে টুকরো কম হলেও হতে পারে l

মানুষের মন!

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ভূত চতুর্দশী, ২০২১

লেখক

ফটফটে সাদা রঙের একটা বাগান বাড়ির সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন সিদোনির স্বামী l এসেই “কেউ আছেন, কেউ আছেন গো বাড়িতে,” বলে, বাইরে থেকেই বিরাট ডাকাডাকি l বিকেল বিকেল ওরা পৌঁছেছে এখানে l মোরাম বিছানো পথ l চারিদিকে অন্ধকার করে এসেছে বাগানের গাছের সমারোহে l বাড়িতে একটা পুরোনো ম্যানশনের ছোঁয়া l সিদোনির মনে হলো হয়তো বা সেই আবছায়া সিঁড়ি বেয়ে যারা দাঁড়িয়ে থাকে কেবলই, এবং শোনে, সেই তারাই বুঝি ওদের ডাকাডাকি চুপ করে শুনছে l ডি লা মেয়র এর কবিতা মনে আসতেই পিঠ বেয়ে এক শীতল স্রোত নেমে আসে l ভয় কি, স্বামী রয়েছেন সঙ্গে আর এ বাড়ির কেউ নিশ্চয় এখনই নেমে আসবে l

“ও কি, তুমি যে ভয় পেয়ে গেলে,” বলেই মুখচুম্বন করলেন মসিয়েঁ জোভেনেল l সিদোনেকে খুশি রাখতেই হবে l
“এমন ভয় পেলে চলবে? আচ্ছা আচ্ছা, এই দেখো তো, আমার কোটের পকেটে হাত গলিয়ে কিছু পাও কিনা l” মসিয়েঁর চুমড়োনো গোঁফ কোলেটের নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে ততক্ষণে ওকে হাঁচিয়ে ছেড়েছে l “উফ কী যে করো না তুমি,” সিদোনির কণ্ঠে আহ্লাদী বিরক্তি l “ওও এ যে একখানা চাবি গো l” স্বামী কিন্তু ততক্ষণে সিদোনিকে বেমক্কা চমকে দিয়ে, সেই বড়ো চাবিখানা দিয়ে দরজা খুলে ফেলেছেন একেবারে l

UNSPECIFIED – MARCH 13: french writer Colette and husband Willy c.1902 (Photo by Apic/Getty Images)

“এস এস” বলে ডেকে নিয়ে গেছেন সিদোনিকে ঘরের মধ্যে l
স্বামীর কিঞ্চিৎ খামখেয়ালিপনার আন্দাজ আছে সিদোনির l কিন্তু তাই বলে অন্য কারো
বাড়িতে এমন ভাবে ঢোকা? “এই নাও, এই তোমার বাড়িঘর” লেখার জায়গা নেই বলো,
হা হা হা হা, তোমার তো আবার এই গাছগাছালি বেশি পছন্দের, তাই না? নাও লেখো, যত্ত খুশি,
কেউ বাধা দেবে না l

“মানে? কি বলছো???

এই সত্যি বলছো?”

আমার লেখার জন্যে কিনেছো এই বাড়িঘর? কি সুন্দর l” প্রতিটি ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সিদোনি l “এই তো এই জানালার পাশে থাকবে আমার লেখার টেবিল, এইখানটিতে সক্কাল সক্কাল বসে লিখবো l আর ওই যে দ্যাখো, ওই বাগানে বার্চ গাছে তলায়, বসে লিখবো দুপুর দুপুর l এক দুপ্পুর লেখা লিখে তবেই শান্তি l তুমি নিশ্চয়ই, তখন বিশ্রাম নেবে l আর সন্ধ্যেবেলা বসবো এই ঘরটাতে l আরাম করে সোফাতে বসে লিখতে দারুন লাগবে l আর তুমি মুখের সামনে ধরবে ধূমায়িত কফি, কেমন ভালো না?” বলেই মুখ টিপে হাসে সিদোনি l স্বামী আগ্রহ নিয়ে বলেন l “হ্যাঁ হ্যাঁ তা নয় তো কি l আমার তো তোমার লেখা নিয়ে কথা l যত লিখবে, ততো। ওই দ্যাখো না কত আগে থেকে মিস্ত্রি লাগিয়ে কাজ শুরু করেছি, তোমাকে চমকে দেব বলেই না ?”

“তাহলে ফার্স্ট ড্রাফট কবে জমা দিচ্ছ ডিয়ার?” স্বামীর কণ্ঠে এই অযাচিত আগ্রহ ভালো লাগে না
সিদোনির l “বসবো গো, সবে তো নতুন বাড়িতে এলাম l কৃতজ্ঞ তোমার কাছে, একটু দেখে শুনে নিয়ে, সব কিছু গুছিয়ে লিখতে বসবো ঠিক দেখো l”

মুহূর্তের মধ্যে গিরগিটির মতো রঙ বদলায়, মসিয়েঁ জোভেনেল l

গলা সপ্তমে উঠেছে তার l
“তুমি এই মুহূর্তে লিখতে বসবে l”
তড়িৎ গতিতে টেবিলের ওপর লেখার কাগজ কুইল দোয়াত এনে রেখে দিয়ে বলে ওঠে, “রইলো এ সব, লেখা শুরু করো এই মুহূর্তে আর দরজাও বন্ধ থাকবে l শুধু মাঝে মাঝে খাবার পেয়ে যাবে যখন যেমন দরকার l” আর তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায় l জেদি বাঘিনীর মতো সেই দরজায় মাথা কুটে মরতে থাকে সিদোনি l


তবু কা কস্য l ওই বিশাল বাড়িটার প্রতিটি অন্দরে কন্দরে তার আকুল মিনতি খান খান হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে l একটা শব্দও লিখতে পারেনি সিদোনি l রাত জেগে জেগে তাকিয়ে থাকে সে আর অনুভবে বুঝতে পারে রাতে নিশুতিরা গুমরে কাঁদে সেই বাড়ির এটিকে, টারেটের মধ্যে, বাড়ির নিচের গুম ঘরে l আর সেই অশরীরীর দল, চাঁদের আবছা আলোয় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে থাকে কার জন্য, কে জানে l তবু সিদোনের মরমী মন কেমন যেন ভেবে নেয়, ওরা ওর সহচর, সমব্যাথী l

খাবার দিয়ে গেছে মসিয়েঁ l ছুঁয়েও দেখেনি সিদোনে l কাল যা হবার হবে l
সে লেখক l লিখতে তাকে হবেই l জীবনের যত ব্যথা পুঞ্জীভূত কালো রক্তের ফোঁটা হয়ে নামবে
আঙুল বেয়ে l লিখতে থাকবে, যতক্ষণ না ব্যথার কণিকা মিলিয়ে যায় শরীর থেকে l আবার নতুন ব্যথা জমা হলে, লিখবে আবার l

শব্দ প্রসবের মতো এমন যন্ত্রনা আর নেই l লেখক মাত্রেই জানে, সে ভারী নিভৃত, জারজ যন্ত্রনা, যার থেকে মরণ ছাড়া মুক্তি নেই l তাই পলে পলে অব্যক্ত, অহল্যা শব্দ নিয়ে নিয়ে ভারী হয়ে ওঠে গর্ভবতী সময় l

ঘর মিলেছে সিদোনির, কিন্তু লেখকের সত্ত্বা গেছে হারিয়ে l এ সব লেখা ছাপা হবে মসিয়েঁ জুভেনেলের নামে l যত হাততালি, যত প্রশংসা, যত টাকাকড়ি, সবকিছু মসিয়েঁরই l

সিদোনি একজন গোস্ট রাইটার l


©অপর্ণা গাঙ্গুলী

ফ্রেঞ্চ লেখিকা কোলেটের জীবনী থেকে… (#Colette, now trending on Netflix)

লক্ষ্মীর ব্যথা

দুগ্গো পুজো হয়ে গেলেই  আমাদের সেই অদ্ভুত মামাবাড়ীটাতে লক্ষ্মী পুজোর জোগাড় চলতো l হাঁড়ির ওপর সোনার মিনে করা চোখ মুখ নাক আঁকা লক্ষ্মী দেবী, সাবেক কালের l অমনিই রয়ে গেছেন, মায়ের ঠাক্মার, ঠাক্মার, ঠাক্মার কাল থেকে l বামনী বুড়ি, তিল থুবড়ি শরীরটা নিয়ে দশমণি হয়ে বসে রয়েছেন সেই ছাদের ঠাকুরঘরে কুলুঙ্গির ভেতরে l সেই তিনিই আবার পূর্ণিমার রাতে দপদপিয়ে হাঁটেন, ছাদে, বারান্দায়, আলসেতে রূপের বন্যা ঢেলে আনমনে বসে থাকেন, চুল ছেড়ে দিয়ে l লক্ষ্মীর পানপাতা মুখে, চিবুকে, নাকে, গলায় হিরে কুচি জোছনা লেগে ঝিকমিক করে ওঠে l ওমা লক্ষ্মী দিব্য করে আলসেতে বসে পা দোলান আর পেঁচার গায়ে কমলকলি হাত বুলোন l এই বাড়িতে লক্ষ্মী বাঁধা কিনা তাই এই বাড়ি, উঠোন, দালান, ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, ঠাক্মার ঘর, পিসমার ঘর, চিলে কোঠা ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারেননা l বুড়ো মন্মথ বহুদিনের পুরোনো মানুষ l লক্ষ্মী পুজোর আগের রাতে ঘরদোর নিকিয়ে পরিষ্কার করে সবে নিচে নামতে যাবে, দেখে কিনা আমার দিদিমা যেন এলো চুলে রূপে দশদিক আলো করে ছাদময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন l সে আলোর ছটায়, মন্মথ বুড়োর পিদ্দিম মলিন হয়ে গেছে l তবে যেই, না “বড়ো মা, এতো রাতে তুমি?” বলে ডেকে ফেলেছে, অমনি ফস করে মিলিয়ে গেছে সেই দপদপে মূর্তিখানি l মন্মথর তিনকাল গিয়ে কিনা এককালে থেকেছে, তাই এই বাড়ির অন্ধি সন্ধি সব জানা তার l “মা মা মা গো, ঘরে বাঁধা থাকো মা” বলেই সে গামলা বালতি নিয়ে নিচের দিকে হাঁটা দিয়েছে l আর তারপর থেকে ওদের মুখে মুখে লক্ষ্মীদেবীর গপ্পো সাত কান হয়ে হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে l

লক্ষ্মী পুজোর দিনের আগে পরে মা লক্ষ্মী দেখা দেন শুনেছি l তাই আমার আর দু চোখ ভরে ঘুম আসে না l সবাই ঘুমোলে পা টিপে টিপে উঠে যাই ছাদে l হুট্ হুট্ হুট্ হুট্ l ওই তো হালকা সোনালী রঙের পালক, মা লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা বসে বসে ঢুলছে  ছাদের রেলিঙে l সে কি ঢুলুনি রে বাবা l আমি কাছে যেতেও খেয়াল নেই l ইচ্ছে হয় বলি, “তোমার মা কই, ও পেঁচা,” কিন্তু ভয় হয় l হয়তো এইখানেই কোথাও তিনি, এই বুঝি প্রকট হলেন বলে l আর আমি এমন, যে কিনা মাকে দেখতে পাই না, অজ্ঞান হয়ে আছি l দোহাই মা, ক্ষমা করে দাও মা l এবারে যেন টিফিনের পয়সা তোমার নামে ভাঁড়ে জমিয়ে জমিয়ে ওই পাশের বাড়ির বুড়িয়া, মামণি, চুটপুটির-পুটপুটির মতো ব্যাডমিন্টনের ব্যাট কিনতে পাই মা l আর তোমার বোনকেও বলে দিলো যেন এইট থেকে নাইনের পরীক্ষায় ভালো ফল হয় মা l আমি চোখবুজে বিড় বিড় করতে থাকি আর সেই পেঁচাটা ঘুম ভেঙে আমাকে অবাক চোখ দুটি আরো গোল্লা পাকিয়ে দেখতে থাকে l মায়ের বাহন, ওকে খুশি করলেও আমার সুফল হতে পারে, এই ভেবে পকেটে রাখা দুটো ক্যান্ডি এগিয়ে দিই ওর দিকে l আর তখনি সেই অদ্ভুত কান্ড ঘটে যায় l চতুর্দশীর ভরভরন্ত চাঁদটা যাকে, পাশের বাড়ির কাঁচা পোয়াতি বুনি মাসির মতো লাগে, একটা দুষ্টু কালো মেঘ টপ করে কেমন ঢেকে দেয় l চাঁদ হেসে উঁকিঝুঁকি মেরে আমাকেই দেখতে থাকে l খুব মেয়েবেলা থেকেই চাঁদের সঙ্গে আমার ভালোবাসাবাসি কিনা l এমন সময়ে ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক করে এসে হাজির এক বুড়ি l দেখলে চাঁদের বুড়ি বলেই বোধ হবে কিন্তু আমি তো এক লহমাতেই চিনে ফেলেছি l সাদা ফসফসে শণের নুড়ি চুলে এই দগদগে সিন্দুর লেপা l মোটাসোটা, বেঁটে সেঁটে থুপথুপে বুড়ি পরণে লাল পাড় গরদের শাড়ি l ওই শাড়ি চিনেছি, দিম্মি ওই শাড়ি মা লক্ষ্মীকে কিনে দিয়েছিলেন গত পুজোয় l ছোট্ট ছোট্ট ফুলফুলে পায়ে লাল টকটকে আলতা, আর কী সুন্দর গহনা পরা l ওই সব গহনা আল্পনাতে আমিই এঁকে দিই কিনা, বাউটি, চুড়ি, মানতাশা, কানবালা, সাতনরী হার, বুবুমাসির মতো চিক-কম নেকলেস, টিকলি, টায়রা আরো কত কী l ছাদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মী দেবী l আমাদের স্কুলের বাঙলা টিচার মিসেস মৈত্রর মতো দেখতে লাগছে ওঁকে l যেন এক্ষনি পড়া ধরবেন l আমি মনে মনে প্রার্থনা করি বিড়বিড়িয়ে l যদি শুনে ফেললে কাজে লাগে l বাহন পেচক ততক্ষণে মায়ের পায়ে সেট করে নিয়েছেন নিজেকে l

কিছুক্ষণ পর আর থাকতে না পেরে বলি – মা গো, আমি তো এতো কিছু চাইলাম, তুমি কিছু চাও মা l আহা তুমি যে দিম্মির থেকেও বুড়ি হলে গো l

মা বললেন, হবেই তো, আমি কম দিন এখানে রয়েছি রে l এতো আদর যত্ন, ছেড়ে যেতে চাইলেও যেতে পারি না l তোরাও তো সব লক্ষ্মী মেয়ে কিনা l তাই বসে বসে বুড়ি হয়ে গেলুম l

তবে দিতেই যদি হয়, ওই তোদের কি সব ব্যাথা বেদনার মলম আছে, একটি দিস ক্ষণে l একটু লাগিয়ে দেখবো l কুলুঙ্গির ভেতরে বসে বসে স্পন্ডিলাইটিস ধরে গেলো রে l আমি জানি, ওই রোগটা দিম্মিরও আছে l তাই ঝপ করে বসে পড়ে বললুম, আহা মা, তোমার মা টিপে দেব?

ব্যাস অমনি সব ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলো কে কোথায় l সেই পেঁচা, লক্ষ্মীদেবী, সেই পোয়াতি চাঁদ আর তার সেই জোছনা l কেবল আমি একদম ভয় না পেয়ে খুশি খুশি নেমে এলুম চাঁদের সিঁড়ি বেয়ে l কাল পুজো, সক্কাল সক্কাল উঠে চাল গুঁড়ি দিয়ে আল্পনা আঁকতে হবে l

তা এবারে লক্ষ্মী দেবীর আল্পনায় নতুন সংযোজন হলো, অমৃতাঞ্জন মালিশের শিশি l তখন ভেবেছি, মালিশ বুঝি একটা চাইবার মতো ব্যাপার? অবশ্য এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই মধ্যযৌবনা বন্দিনী কমলার কষ্টের কথা l

আল্পনা আঁকছি, দিম্মি বললেন, ওটা কী রে, সরস্বতীর দোয়াত, লক্ষ্মীদেবীকে? লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বললুম, ভয় নেই মা, কাউকে বলবো না, তোমার ব্যথার কথা l পাকা বুড়ির মতো করে বললুম, মেয়েদের যে ব্যথা বেদনা চিরকাল লুকিয়ে রাখতে হয় মা l

দিম্মি আরও বললেন, পাগলী মেয়ে কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ে!!

আমি সদ্য দেখলুম, হাঁড়ির লক্ষ্মী দেবী ঝিকিমিকি হাসছেন l

মন কেমন করে…

আজকাল বড়ো মন কেমন করে l

পূজাশেষের বিসর্জনের তিথিতে, সিঁদুরলাগা মায়ের গালের ছায়া দর্পণে ভাসলে,
মন কেমন করে l মায়ের জল ভরা চোখ দেখতে পারি না, তাই সরে থাকি l যেন বধূমাতার মুখ, আহা গো, পুজো শেষে স্বামীর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে ফেরা মধুর বিধুর মুখখানি l পুত্রেরও মুখ শুকনো, আবার সেই কাজের জোয়াল কাঁধে, প্রবাসে l ‘তবু যেতে দিতে হয় l’ ওদের আত্মার কিছু কিছু অংশ চুরি করে রেখে দিই নিজের কাছে, অন্তরতম প্রদেশে l মাঝে মাঝে উন্মুক্ত করে দেখি সোনামুখগুলো l মন কেমন করে l

সন্ধি পুজোর ঢাক কাঁসরে মায়ের মধুমঙ্গলী মুখ l ভরভরন্ত l স্বামীসুখে সুখময়ী l সব্বার জন্যে সেই সব সুখশান্তি প্রার্থনা করি l যত বয়স বাড়ে, মা আর মা থাকে না, হয়ে ওঠে মেয়ে l কেমন কোলে এসে বসে দেখো, অলক্তক রাঙা পা দুটি মেলে l এতদিনের মা আমার, সেই দশপ্রহরণদায়িনী দুর্গা, অসুর বিনাশিনী, অশুভ সংহারিণী মা কেমন করে যে মেয়ে হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে l মায়ের টোপলা গাল টিপে দিয়ে ‘আয় আয় মা আয় মা হৃদয়ের রমা পরাণ পুতলি গো’ এইসব বলে চুম দিই ওঁর গালে l

মন্ত্রপাঠ চলছে মণ্ডপে –

ওঁ হ্রীঃ শ্রীঃ চামুণ্ডা দেবতায়ৈ নমঃ

ওঁ ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে

ওঁ ভদ্রকাল্যৈ ভগবত্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ

ঘরের মেয়ের ত্রিনেত্র তখন জেগে ওঠে l মা যেন সমস্ত প্রকৃতির মাঝে তাঁর উর্জা শক্তি প্রদান করতে থাকেন সেই ক্ষণে l নিমেষে সেই আদরিনী মাতা, তারা, উগ্রা, মহোগ্রা, বজ্রা, চণ্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, কালী, সরস্বতীরূপ ধারণ করেন lকামেশ্বরী চামুণ্ডা তারিণী মাতা তিনি l ওই টুপটুপ ফোলা ফোলা গালের মায়ের মধ্যে থেকে করাল দংষ্ট্রা, শিরোমালা বিভূষণা দেবী কাত্যায়নী রূপ দর্শন করি l চামুন্ডা দেবী, অসূয়ামথনী স্বয়ং নারায়ণী রূপে শোভিতা l এই সব ক্ষণে, ধুপ ধুনোর গন্ধে, ঢাকের বোলে, চামরের ব্যজনে, ১০৮ প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত ক্ষণে, কী জানি কিসের জন্যে, কোন ফেলে আসা সময়ের কথা ভেবেই বুঝি, বড়ো মন কেমন করে …

শিবসতী মা আমার, বাপের বাড়ি এসে আলতা মাখা পা ফেলে ফেলে দপদপিয়ে হাঁটে l বাপের বাড়ি এসেছে l সঙ্গে পুত্র পুত্রী l অর্গলহীনা, বাঁধনছাড়া শিবের সংসারের গৃহিনী উমা l আয়েশ করে কচুর শাক আর পান্তা ভাত রেঁধে দিই l মানস পূজা l এ রান্না সারা বছরে আর হবে না l হবে সেই পরের দশমীতে l মা আমার, দশ হাত বের করে গবগোবিয়ে খায়, দেখো l বেশ করে খেয়ে নেয় সাপ্টে সুপ্টে, মেখেমুখে, ছেলে মেয়েদের নিয়ে l সন্দেশ মেখে মুখে দিই ওদের সব্বার, পানে কর্পূর, সুপারি, লবঙ্গ, এলাচ, কাবাব চিনি, খয়ের চুন, সব দিয়ে আচ্ছা করে মনোহরা পান সেজে ঠুসে দিই মায়ের মুখে l টলটলে মুখখানি, তাম্বুলরসসিক্ত হয়ে কেমন আদুরেপানা হয়ে ওঠে দেখো l গাল ধরে আদর করি চুমো খেয়ে, বলি, আবার আসিস মা l মা চুম চুম করে পান খান, আর হাসেন, বলেন, এতো আদর, না এসে উপায় কি l গোধূলিতে মায়ের বাড়ি ফেরার পালা l বড়ো মন কেমন করে গো …

জিনিস পত্র বাঁধাছাঁদা হয়ে গেলে পর, গাড়ি ডাকে ছেলে l ঘরের সবটুকু আনন্দ চলে যায় ওদের সঙ্গে l ওরা ভালো থাকে, খুশি থাকে, ঘুরে বেড়ায়, নীড়ে ফেরে আবার, কেমন চুলবুল করে, গান শোনে, টিভি দেখে, মন ভরে থাকে l তা হোক, আমি ওদের এই কয়েকদিনের চুলবুল পাখির ডাক, হৃদয়ে ভরে রাখি, অবসরে বের করে শুনবো বলে l কিছু কিছু কথা ছবি কখনো হারায় না যে l আমার আত্মার একাংশ, ওদের সঙ্গে গাড়িতে চেপে, ট্রেনে চড়ে চলে যায়, ওই দূরে, প্রবাসে l

আর উৎসবের বাতি সব নিবে গেলে, কার ঘরের মেয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্যে পাড়ি দিলে, সমস্ত মন ভরে তার মঙ্গল প্রার্থনা করি …

কেবল, এখানে একটা ভিজে মন শুয়ে থাকে একা বিছানায় l

আবারও ‘এস এস মা ও হৃদয় রমা, পরাণ পুতলি গো’

বড়ো মন কেমন করে …

ভালো বাসার দিনকাল – সেই ট্র্যাডিশন …

নাহামের আলোআঁধারী দোকানঘর l এই দোকানটিকে দেখলেই এস ওয়াজেদ আলীর সেই উক্তি মনে পড়ে l “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিয়াছে l” কাঁচের আলমারি ঘেরা কত না কেক প্যাটির ভিড় সেখানে l দোকানে ঢুকতেই খুটখুটিয়ে উঠে আসে বুড়ি মেম l আমাকে সওদা করতে সাহায্য করতে পারে ভেবে l দোকানে ঢুকলেই কত না স্মৃতিগন্ধ ভেসে আসে l কত আদরের, স্নেহমাখা মুখ, কত গল্পকথা, ইতিউতি ছড়ানো নাহামের ওই দোকানটায় l

ম্যাজিপান দেওয়া আখরোট মোড়া ক্যান্ডি বেছে নিই, ছেলেমেয়েদের মুখ মনে করে l এ ওদের ভারী পছন্দের l আরো আছে পেস্ট্রি, গার্লিক ব্রেড, চিজ স্ট্র যাদের স্বাদ, গন্ধ অন্য সব কেক দোকানের থেকে ভারী আলাদা রকমের l বছরের পর বছর কেটে গেলেও, এঁরা এঁদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখে গেছেন l কেবল, এই দোকানে ঢোকার সঙ্গী বদলে গেছে আমার l বাবার হাত ধরে লাফাতে লাফাতে আসা ফ্রক পরা কচি মেয়েটি আজ বিগতযৌবনা প্রৌঢ়া l সঙ্গীটিও এমনই l ঠিক এই বয়সে এসে যেমন পুরুষের হাত ধরতে চায় মেয়েরা l শান্ত, সমাহিত, নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব l হোঁচট খাবার মুহূর্তে হাত ধরে ফেলার যে সঙ্গীটির পথ চেয়ে থাকে এক নারী, পেছন থেকে গাড়ি এসে আলটপকা বিঘ্নের হাত থেকে বাঁচাবার সেই সঙ্গীটির জন্যে অপেক্ষার অবসান শেষে সে এসে দাঁড়িয়েছে l পিতার স্নেহে আদরে, যত্নে, লালন করার মতো সঙ্গীটি l “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিয়াছে l”

যাইহোক, ওদিকের জানালায় রাখা কেকের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় তবু ইচ্ছে হলেও আমাদের কেক পেস্ট্রি মুখে দেবার সাহস নেই আজ আর l চায়ে চিনি বিলুপ্ত আজ বেশ কয়েক বছর l অবশ্য আজ তাতে কিছুই আসে যায় না l আজকাল অন্যকে দিয়ে সুখ বেশি পাই l তাই যা পারি সঞ্চয় করি ঘরের জন্যেই l স্মৃতি হাতড়ে দেখি, এই দোকানে রঙিন রাঙতায় মোড়া চকলেট ললিপপ বাড়িয়ে ধরেছে বাপি l সে তো আজ বহু বছর আগের কথা, তবু কেমন মনে হয় এই তো সেদিন l ততক্ষণে সে আমার আহরণ করা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে ব্যাগে l উদ্দেশ্য, আমাকে ব্যাগ বইতে না দেওয়া l চোখে জল আসে l এমন করে বাপিও, মাকে নিয়ে পথ চলতেন l “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিয়াছে … “

টুকটুক করে পথ চলি দুই জীবন যাত্রী l গন্তব্য জানা নেই l রাস্তায় কোনো সরাইখানায় বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু হবে পথ চলা l

“সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিয়াছে l”

পরশ

বাড়ির সামনে একটা গাছ ছিল l তার নাম নাকি পরশ l কে কমনে কখন সে গাছের নাম আমাকে বলেছিলো, আজ আর মনে নেই l তবে নামটি ভালো লাগায়, মনের শব্দকোষে ওকে ঠাঁই দিয়েছিলাম চিরতরে l গাছেরা সবাই বন্ধু আমার, সে কথা কারও অজানা নয় l গাছেদের জড়িয়ে ধরে আমি ভালো থাকি l দুঃখের দিনে, কষ্ট পেলে, গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালে, ওরা গায়ে মাথায় ফুল পাতা ফেলে আদর জানায় l ওই পরশ, যার হলুদ হলুদ ফুল, বেশিদিন হলেই সেই ফুলে হালকা বেগনি রঙ ধরে, যেন বড্ডো অভিমানী গাছ l যখন কাছে ছিল, ব্যালকনি থেকে আমি ওর নাগাল পেতাম l ডাল টেনে ধরে, আদর করেছি কতদিন, ফুল তুলেছি, কিচ্ছু বলেনি l কিন্তু সেবার কি হলো, সামনের গাব গাছ ঝড়ে উপড়ে গেল l খুব কষ্ট পেয়েছি আমি, কিন্তু সব থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিলো ওই গাবের পাশের নাগকেশর গাছ l কত বর্ষারাতে ওদের ফিসফিসে কথপোকথন আমার কানে ভেসেছে l যেন শুভঙ্কর আর নন্দিনী গাছ দুটো l ওদের শীৎকারের আওয়াজ পেয়ে দয়িতের পথ চেয়ে চেয়ে কত বিরহ রাত যে ভোর হয়ে গেছে l

তাই সকালে উঠেই যখন দেখি, গাব মরে পড়ে আছে, আর ভীষণ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে নাগকেশরের সব ডালপালা .. .তখন ওর কাছে ছুটে না গিয়ে পারিনি l যেন চরম অভিমানে ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানাচ্ছে নাগকেশর – “কেন এমন করলে ঠাকুর, গাব কে কেড়ে নিলে এমন করে ?” আমি নাগকেশরকে আলিঙ্গন করে বললাম, “গাব কোথাও যায় নি, এখানেই আছে, তোমার কাছে l তোমার আত্মায় মিশে আছে ও l” প্রিয়জন বিয়োগে যেমন আমরা সব বলে থাকি l

দূর থেকে দেখলো পরশ গাছ আমাকে l কিচ্ছু বললো না l আমার মন বলেছে ও কষ্ট পেয়েছে গাবের এই হঠাৎ নেই হয়ে যাওয়ায় l কিন্তু তারপর কি যে হলো, ধীরে ধীরে সরতে লাগলো পরশ l তার পরশ পাওয়া আমার আর হলো না l ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালে আর ধরতে পাই না তাকে l অভিমানী গাছ l কেমন সরে গেলো আমার থেকে l কেন l অনেক ভেবেও কুলকিনারা পাই না l বুঝি, আমাকে মনে মনে তৈরী করে নিচ্ছিলো, ওর অবশ্যম্ভাবী চলে যাবার কথা জেনেই?

কিন্তু গতকালের জন্যে তৈরী ছিলাম না l সবে রাস্তায় পা দিয়েছি, দেখি, কে বা কারা পরশকে মেরে কেটে শেষ করে রেখে গেছে l আর কিচ্ছু নেই ওর, কিচ্ছু না l ওর হাত, পা, মাথা, বুক, ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে চারিভিতে l আমি ওর গায়ে হাত বোলালাম l সামনে দুগ্গো পুজো l ঝাঁকড়া চুল পরশ একটু বেশি ঝুঁকে থাকে রাস্তায় l ওদের অসুবিধে হবে প্রতিমা নিয়ে যেতে আসতে l মা গো, এ তোমার কেমন বিচার গো মা l একটা নিরীহ গাছ …

দেখি, ও পারে দাঁড়িয়ে নাগকেশর মাথা দোলাচ্ছে, ওর চোখে জল l ওর চারিপাশে আর কেউ নেই l

(পরশের ছিন্ন ভিন্ন দেহের ছবি তুলতে মন চাইলো না l ওকে মনে রাখবো ভ্যান গঘের “অলিভ ট্রিজ” ছবির মধ্যে দিয়ে l ও অনেকটা এমনই দেখতে ছিল কিনা l)

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ভেগুর দোকান

ভেগুর দোকানে যে একবার গেছে, সে বারবার যায় l আমারও সেখানে নিত্য আসাযাওয়া l কারণ আমি অমন পূর্ণিমা চাঁদের মতো গোল রুটি বানাতে শিখিনি l তাই ওই ভেগুর দোকান …পাড়ার প্রৌঢ় ছাতিমগাছটার তলায় দোকান দিয়েছে ভেগু l বেশ বড়োসড়ো খাবারের দোকান, রুটি, পরোটা, রুমালি সবই গনগনে আগুনে তৈরী করে দেয় সে আর তার সহকারীরা, পরম যত্নে l রুটি কেনার জন্যে দাঁড়িয়ে পড়েছি l সাতসতেরো লোকজনের মেলা l রুটি, তড়কা, ডিম্ তড়কা, মেটেগিলের তরকারী, এ সব হরবখত কিনছে লোকজন l ভেগুর দোকান l তবে ভেগু যে শুধুই বসে বসে টাকা গোনে তা নয় l রীতিমতো হৈহৈ করে কাজ করে যায় সব্বাইকে নিয়ে l ভেগুর দোকানের আলোআঁধারিতে কুলুঙ্গির লক্ষ্মীদেবী হাসেন l

টাটকা রুটির ফুরফুরে গন্ধে মেতে ওঠে হৈমন্তী বাতাস l ছাতিম ফুল আর রুটি সেঁকার গন্ধ মিলেমিশে এক দারুন ঘর ভোলানো সন্ধ্যেরাতের কথা মনে করিয়ে দেয় l কয়লার উনুন গমগম করে জ্বলে আর ভেগুর সহকারী কিশোরী ফুলবসিয়া টপাটপ রুটি সেঁকে অভ্যস্ত হাতে l আজকের দিনে ওই শিশু শ্রমিক, স্কুলে না যেতে পেয়ে শিশু কিশোরদের খেটে খাওয়ার গপ্পোসপ্পো করতে বসিনি l আজ বলবো জীবনের গল্প l

তা যা বলছিলাম … সে রুটি চটাপট পিঠ উপুড় করে, রুটি সেঁকার জাল ধরিয়ে দেয় ভেগুর হাতেই l এক একটি রুটি যেন পেট ফোলা বেলুন l আর ভেগু সার্কাসের জাগলার l কি যে আজব কায়দায় রুটি ছুঁড়ে দেয় উপরে, আর জাল পেতে অদ্ভুত কায়দায় ধরে নিয়ে সে রুটি চালান করে একটি বড়ো ঝুড়িতে l ততক্ষণে, ফুলবসিয়া ফয়েলর বাটিতে ভরে ভরে দিতে থাকে তড়কা, মেটেগিলে, পাঁচমিশালি যে যেমন চায় l ওদিকে আর দু’জন বানায় রুমালি রুটি l ময়দাকে মেখে ছুঁড়ে দিচ্ছে ওপরে আবার ধরে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ফের ছুঁড়ে দেয় অবাক কায়দায় l তারপর একটা বড়ো উল্টোনো কড়াইয়ের পিঠে সমান করে বিছিয়ে দেয় সেই রুমালি l পাতলা ফিনফিনে সাদা রুমালি তৈরি হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই l অনেক কাজের অবসরে এই অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় তৈরী রুটি বানানো দেখতে চমৎকার লাগে আমার l থাক গে, কিছু দেরি হয় হোক, আমি কেমন অদ্ভুত এক নেশায় ভেসে যেতে যেতে রুটির জন্যে অপেক্ষা করে থাকি l ভেগুর কাছে ভেদাভেদ নেই l যে আগে আসবে, সেই পাবে, যে দেরি করবে, সে একটু দাঁড়াবে l

দেখতে দেখতে কেমন বয়ে গেছে সময় l কুয়াশাধরা টিমটিমে আলোয়, ভেগুর দোকানপাটের খদ্দের আমিও l হঠাৎ কানে আসে –
“জালটা কোথায় রাখলি বাপু … দিলি তো কাজের দেরি করে?” গলা বেশ উচ্চগ্রামে l
এতো জন দেঁইড়ে আছে, কী হবে এখন?”
ওরে ও গণেশ, দেখনা রুটি সেঁকা জাল খানা হেইরে গেলো যে রে l
এ মেয়েটা হয়েছে কোনো কম্মের না l” বকার উদ্দেশ্য ফুলবসিয়া l
চোখ-ছলছল মেয়েটির দিকে তাকাই l ছিন্ন বেশ, রুক্ষ চুল l মনে হয়, ওর জীবনের একটিমাত্রই উদ্দেশ্য – ভেগুর দোকানে রুটি বানানো, ওকে সাহায্য করা l
এই কাজের মধ্যে চোখে জল এলে কারই বা কী l
ভেগুর চোখ এড়ায়নি ফুলের কান্না l
“ও মা ওই দেখো, কাঁদিস নি মা গো, এতো লোক ঠেলতে হয়, কি বলতে কি বললুম l”
মেয়েটির জেদি চিবুকে অভিমানের ছোঁয়া l
আমারও মন খারাপ হয়ে যায় l আর তখনি কোত্থেকে গণেশ এসে, তাকের পেছন থেকে বের করে দেয় জালখানা l ভেগুকেই বকে, “তুমিই রেখেছো কাকা, শুধু শুধু মেয়েটাকে গাল দিলে l”

এবারে, মেয়ের চোখের জল ঝর্ণার মতো ঝরে পড়ে l
ভেগু অপ্রস্তুত l আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখছেন দিদি, মা-বাপ্মরা ভাগ্নি আমার l
এতো কষ্ট পেলে চলে? আরে তোকে কি আমি বকিচি রে বাবু?”
মেয়েও সুযোগ নেয় অমনি l চোখ মুছে বলে, “যাও, মামা, ক্ষুধা পেয়েছে, মোড়ের দোকান থেকে শট করে দুটো ঝাল বিস্কুট এনে দাও দিকি l আমি পরের রুটিগুলো দেখছি l” এদের হাসি কান্না রাগ অভিমানও বুঝি এদের রুটি বানানোর মতোই সহজ, সরল l

ভেগু আর তার পালিতা কন্যা ফুলবসিয়ার স্নেহ ভালোবাসার একটি ছোট গল্প চোখের সামনে ফুটে ওঠে l হাতে গরম রুটি নিয়ে আমি বাড়ির পথ ধরি, একটুখানি পথ, সামনেই বাড়ি l ওপরের ব্যালকনি থেকে এইসব গপ্পোগাছার স্বাদ পাই না l এসব প্রত্যক্ষ করতে হলে জীবনের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হতে হয় l

নাহ, ঝরা ছাতিমের গন্ধে আর কান্না আসে না, ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে ছাতিম গাছতলা l
এখনও ভালোবাসা আছে পৃথিবীতে!

©অপর্ণা গাঙ্গুলী

মা

ঠিক বেলা চারটে বাজলে মায়ের ঘুম ভেঙে যেত l আমরা আকুল হয়ে সেই মুহূর্তটির অপেক্ষায় থাকতাম l মা কখন চোখ খুলে চশমাটি পরবেন l তখনকার দিনেও বেড়ালচোখ চশমার প্রচলন ছিল l ঠিক যেমনটি কুহেলি ছায়াছবিতে সুমিতা সান্যাল পরেছিলেন l কেবল ধারের ডাঁটি দুটি সোনালী l এ’সব আমার সৌখীন বাবার পছন্দ l আর চশমা পরলেই মাকে খুব বেশি “মা মা” মনে হতো আরো l সেই মেয়েবেলাতে, আমাদের দুইবোনেরই অনর্থক খিদে পেতো, কেন কি জানি l মা ঘুমুলে, আমরা বিস্কুটের ওপরে কুলের আচার, চিজের টুকরো সাজিয়ে, মিষ্টির ছোট টুকরো দিয়ে আর একটি বিস্কুট চাপিয়ে কুচমুচ খেতাম, একটু দূরের ব্যালকনিতে বসে l মা টেরও পেতেন না l এখন মনে হয়, পেতেনও বুঝি বা, কিন্তু ঐটুকু আশকারা দিয়ে রাখতেন, দূরে মামারবাড়িতে-থাকা মেয়েদের, গ্রীষ্মের ছুটিতে কাছে রাখার অবসরে l

মা উঠেই হাত ফিরিয়ে খোঁপা বেঁধে নিতেন, মুখ হাত ধুয়ে যেতেন রান্নাঘরে l মায়ের ইস্ত্রি করা শাড়ি ব্লাউজ পাটে পাট থাকতো, যেন এতক্ষণ একভাবেই বসে ছিলেন, মনে হতো l মা উত্তীমদাদা, বা পরে জয়দেব দাদাদের সহযোগে, পরোটা ভাজতেন l ছোট ছোট করে আলু, পটল, কুমড়ো কেটে উপাদেয় বাটি চচ্চড়ি তৈরী করে দু হাতে দুই থালা নিয়ে আমাদের খাওয়াতেন l সে সব অমৃত ভোগ … বসে বসে খাওয়া দেখতেন মা l হয়তো পরে, বাবা আসলে একসঙ্গে খেতেন একটু l আমরা কেমন বেখেয়ালে l মাকে কখনো জিজ্ঞাসা করিনি, মা তুমি খেলে? সেই মেয়েবেলায় l জানি, মা যে মা … আমাদের খাওয়াবেন, ধোয়াবেন, গুছিয়ে রাখবেন l মা যে দেবী, মায়ের বুঝি খেতে হয়?

মা রাগ করলে বেশ বোঝা যেত l সব কথা বন্ধ হয়ে যেত মায়ের l বলতেন, দুষ্টুমি করলে তো? যাও, আমি মা হবো না আর l এ সব বকুনি বড়ো ভয়ঙ্কর ছিল বৈকি … সে কি, মা যদি মা না হন, কে হবেন? মা যদি পুপু, বন্টু, লালি দিদি, মৌয়ের মা হয়ে যান শেষে? মা বুঝতেন, এই কথাতেই মেয়েরা জব্দ হবে l আর আমরা ভুলেও আর সে কাজ করতাম না l

মা সাজতেন না মোটেই l এমনিই মাকে কি যে ভালো দেখাতো l কপালের বড়ো সিঁদুরের টিপ্ যেন সকালের ঝলমলে সূর্য্য l কোনোদিন একটুও বেঁকে যেত না l আর শাড়ি ব্লাউজ মার্জিত রুচিশীল l বেশির ভাগই হালকা রঙের l তখনকার মায়েদের হোয়াইটেক্স মাখার চল ছিল l ঐটুকুই l তৈরী করা কাজলের একটু ছোঁয়া l আমার মাসিরা, মামীরা, কোয়ার্টারের কাকিমারা হাই হিল জুতো পরতেন, ভ্যানিটি ব্যাগ নিতেন, আর হাত কাটা জামা পরতেন তখন l আমার কেমন মনে হতো, মা কেন পরেন না ও সব? খুব ইচ্ছে হতো, মা ঐরকম সাজবেন, একবার বলে ফেলেছি, আর মায়ের বকুনি … আর রক্ষে আছে?

শেষবারে যখন মা হাসপাতাল থেকে দু’দিনের জন্যে বাড়ি আসতে পেরেছিলেন, আমি বুঝি নি, মা চলে যাবার জন্যেই একবারটি এলেন l পায়ে নেল পেন্ট লাগাচ্ছি মায়ের পায়ের কাছে বসে l আগে খুব বারণ করতেন, বলতেন, ওরে তুই কি পাগল হলি, সঙ সাজাচ্ছিস? এবারে বললেন, পরিয়ে দে, এবার যেতে হবে … আর বাধা দেব না l রাজেন্দ্রানী হয়ে চলে গেলেন মা l চশমা খুলেই l চশমা পরে উঠে বসা হলো না l আকুল হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমরা, যদি উঠে পড়েন, গুটি গুটি পায়ে মেয়েদের জন্যে নাতি নাতনির জন্যে লুচি ভাজতে ছোটেন …

আজ মায়ের জন্মদিন l মাঝরাত, ১৬ আর ১৭ সেপ্টেম্বরের সন্ধিক্ষণে l

হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মা/দিদিভাই
ফ্রম রুপারাণী, তিন্নি, বাবু, পল্লু এন্ড রিঙ্কুমণি …

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ছবি – শ্রী যামিনী রায়

কলকাতার দিনলিপি

শহরটা অনেকক্ষণ আগেই বর্ষাবেলার ব্যস্ততা কাটিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছে l ঠিক এমন সময়ে শুভঙ্কর এসে হাজির নন্দিনীর পরিচিত সেই জায়গাটিতে l প্রতিবারের মতোই, শুভঙ্করের কাঁধে ব্যাগ, চোখের ওপর এসে পড়া অবিন্যস্ত চুল আর চশমার আড়ালে গভীর চোখ দুটি l নন্দিনী বর্ষানদীর মতো প্রগল্ভা আজ, কিছুটা অগোছালো যেন, তবু শুভঙ্কর সাগরে মিশে যাবার জন্যে দারুন উন্মুখ l

রাস্তার দোকানে চা খেতে গিয়ে একটু দেরি হলো নন্দিনী, তুমি কতক্ষণ অপেক্ষায় ?

  • অনন্তকাল শুভঙ্কর l সেই নিয়ে কোনো সংশয় আছে বুঝি ?
  • ঠিক তা নয়, তোমাকে অপেক্ষায় রাখলুম …
  • চলো আর অপেক্ষা না করে সমুদ্রে ভেসে পড়ি …

সকালবেলার ফ্লুরিজ বেকারি l কবেকার, কতদিনের সে দোকান কে জানে l মনে হয় সে সব দোকানপাট যেন অনন্তকাল ধরে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে l জানলার ধারে ওদের সেই পছন্দের জায়গা, ঠিক সেখানে, যেখানে সূর্য্যের আলো এসে নন্দিনীর চোখ দু’টিকে আরো বাঙময় করে তোলে l ঠিক সেখানে, যেখানে এসে বসলে শুভঙ্করকে আরও কাছের মনে হয় নন্দিনীর l আড়াইশো বছর আগে ইংরেজের কলকাতায় কি এমন এক সকালেই কোনো এক মার্থার চোখে তাকিয়ে জন অঙ্গীকার করেছিল চরমতম ভালোবাসার ? একেই বুঝি বলে, ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে ?’ জানা নেই, তবে নন্দিনীর দেজা ভ্যু হতেই থাকে অহরহ আর শুভঙ্করের দার্শনিক মন খুঁজেই চলে কতোকিছুর উত্তর, নিরন্তর l

  • কে আমরা বলতে পারো নন্দিনী? এই যে দেখা, কেনই বা, কি উদ্দেশ্যে ?
  • না বলতে পারি না, কিন্তু বুঝতে পারি … এই বিরাট কালচক্রে, সব ঘটনাই যে
    ঘটবে, তা পূর্বনির্ধারিত l
  • কে নির্ধারণ করে সে সব? কে বলে দেয় নন্দিনী আর শুভঙ্কর বার বার প্রতিবারই
    এমন করেই দেখা করবে ফ্লুরিজে, কোনো প্রাতঃরাশের মুহূর্তে, কখনও মার্থা জন,
    কখনো শুভঙ্কর নন্দিনী হয়ে ?
  • কালপুরুষ l

প্রেক্ষাপটের বদল ঘটেছে l মাথার ওপর অসংখ্য তারাজ্বলা চাঁদোয়া l কালের ঠিকানা জানতে বসেছে, দুটি মানব মানবী l এ’সব তাদের অজানা নয় কিছুই, তবে প্রতিটি জন্মের স্মৃতির প্রলেপ পড়ে ঢেকে গিয়েছে অনেকটাই l কসমিক কলিসনের হিসেবে নিকেশ চলছে মাথার ওপর l হাতে হাত এই দুই মানব মানবী একাত্ম হয়ে রয়েছে l বিড়লা তারামণ্ডলে মিছিমিছি-তারাদের নিচে এই আত্মমগ্নতা l এমন করে কতরাত তারাভরা আকাশের নিচে কাটিয়ে দিয়েছে তারা l কেউ তার হিসেবে রাখেনি l
এই বিশাল কালচক্রে আমরা এক একটি বুদ্বুদ, কি বলো শুভঙ্কর l
তা আর বলতে, এই আছি, এই নেই গো l
আছো? না নেই? বলেই সজোরে চিমটি শুভঙ্করের হাতের ওপর l
উহঃ, আঃ কী যে করো নন্দিনী … আছি রে, আছি আমি …
আমিও আছি গো …

মেঘলা মনখারাপি দিনে সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল কেমন লাগে কে জানে l আজ নন্দিনীর সঙ্গে সঙ্গে শুভঙ্কর, তাই একটু অন্যরকম দিনটা l তবুও, এদিক ওদিকের স্মৃতিফলক দেখতে দেখতে শুভঙ্করের ভীষণ কান্না পেলো l ওই যে ইংরেজ রেভারেন্ড যাঁকে ভারতীয় সৈন্যরা মেরে ফেরেছিলো হঠাৎই, তাঁরই স্মৃতিফলক এটি l কি জানি কেন, বুক মুচড়ে ব্যাথা করে ওঠে ওর l নন্দিনীর হাত চেপে ধরে বলে,

  • ওই যে সাহেব এমন অকালে, এই ভাবে মারা যান, তাঁর কথা ভাবছো, নন্দিনী?
    দেশে তাঁর প্রিয়া, হঠাৎই তাঁর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পায় l
  • হুম l বিহ্বল নন্দিনীও l এতো মরমী শুভঙ্কর ! তা তো হবেই, ঠিক এমনি কাউকে চেয়েছিলো যে ও l
  • তোমার কি কিছু মনে পড়ছে, নন্দিনী?
  • ভাবছি সে দিনের কথা l যেদিন,জন সাহেবের মৃত্যুসংবার এলো, সেদিন ওই মার্থা, মানে আমিও …
  • হ্যাঁ সব শেষ l কালের হিসেবে আর কে রাখে বলো l তবু বাস্তব হলো, এই ক্যাথিড্রাল, আর ওই স্মৃতিফলক আগামী কত শতাব্দী ধরে, সেই নিদারুণ প্রেমের কিস্সা বুকে বয়ে বেড়াবে l

এখন ফার্স্ট ফ্লাশ – লভ ইন এ বাইলেন l নন্দিনী শুভঙ্করের প্রেমের আঁতুরঘর l তাই বুঝি, এখানেই ফিরে ফিরে আসে ওরা l সেকেন্ড ফ্লাশে মুখ ডুবিয়ে এমন করেই কতদিন কথা বলে চলেছে কে জানে ! আজও তার ব্যতিক্রম নেই মোটেই l অলিতে গলিতে প্রেম যারা খুঁজে পায় নন্দিনী আর শুভঙ্কর তাদেরই অন্তর্গত যে l

  • দিনের শেষে তোমার চোখের চিকচিক আমার নজর এড়ায়নি নন্দিনী l
    -আর তোমার গলায় যে বিষাদের সুর বাজলো, কানে কি আর বাজেনি মশাই ?

এমনি হয়, চিরকাল ধরেই, এ সব দেখা হওয়ার, চলে যাওয়ার শেষ আসে আবার শুরু হবার জন্যেই l
এ সব কোনো যাওয়াই নয় l ফেরার প্রস্তুতি l
আবহমানের …

অপর্ণা গাঙ্গুলী

“এ ঘরে বসত করে কয়জনা”

দেহের খাঁচাকে ঘর বলেন সহজিয়া দেহতত্ত্বের মানুষজনেরা l শ্রী শ্রী ঠাকুর বলছেন শ্রীমাকে, “আমি আর কোথায় গেছি, এই ঘর থেকে ওই ঘরে l” এখনকারের এই দেহ ঘরটি নিয়ে বসবাস করি একটি ইঁটপাথরের ঘরে ইদানিং l তা সেই ঘরটি জুড়েই সব কিনা l দরকার মতো সেখানেই বসে সারাদিনের পাঠশালা; সেখানেই চলে বইপড়া, লেখাজোখা l সে ঘর আমার চিরসখির মতো জড়িয়ে-মুড়িয়ে থাকে আমার যাপনে l তাই বলি, ভার্জিনিয়া বলেছিলেন, সেই কবে, এক চিলতে, এক রত্তি এক ঘরের কথা l একজন লেখক মনের নারীর যেটুকু সম্বল l কোনো বৃদ্ধা পিসিমার থেকে পাওয়া কিছু টাকাকড়ি, আর একটি ঘর, এই নিয়ে সুখেশান্তিতে চলতে পারে লেখালেখি, লিখেছেন ভার্জিনিয়া l তবু ওই ঘর ছেড়েই একদিন পকেট ভর্তি পাথর নিয়ে ডুব দিয়েছিলেন নদীর অতলে l কোনো অন্য ঘরের সন্ধান পেতেই হয়তো l

যা হোক প্রশ্ন হলো, ঘরের নয়, শান্তিপূর্ণ বসবাসের l বাবুইয়ের বাসায় যে শান্তিটুকু বিরাজ করে, চড়ুইয়ের ঘরে, তা থাকে কি ? কি জানি কখন ভেঙেচুরে যায় চড়ুইয়ের ঘর l সে ঘরখানি যে তার নিজের নয় কিনা l

তবু ওই ঘরটুকুর আশ্রয়ে ফিরে ফিরে আসা কেন? কেন মায়ের স্নেহ দিয়ে দুই হাতের ফেরে বাইরের পৃথিবীর, মলিনতা, অপমান, সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করে ওই একরত্তি ঘরখানি l ঘরের ঢুকে দরজা বন্ধ করলেই সবটুকু শান্তি মেলে l এখানেই নিজেকে নিজে ফিরে পাওয়া l ঘর থেকে বেরোতে না হলেও কিছু না l বেশ কেটে যায় দিনের পর দিনের পর দিন l অবসরে, জানালার পাশে বসে জীবনের চলাচল দেখা যায়, রাতে জানালার পাশে জেগে থাকে চাঁদ তারা l এক রাশ জোছনা এসে ভাসিয়ে দেয় ঘরকে l খিলখিল হাসি শুনি, ঘরের l আনন্দে মেতে থাকে ঘর l আমি থাকি, আমার আমি থাকে, আমার কবি থাকে, আমার লেখক থাকে, আমার শিক্ষক থাকে, আমার শিল্পী থাকে, আমার ঈশ্বর থাকে আমার এই ঘরে l

এই সবের মধ্যে একলা থাকি না কখনো l
যে বলে, ঘর থেকে বের করে দেব, সে ভুল বলে l

আর সময় এলে? এ ঘর থেকে ওই ঘরে চলে যাবো এক লহমায়, ব্যাস … আমার ঠাকুরের মতো l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ভালো বাসার দিনকাল – ঘরে ফেরা

কোনো কোনো মানুষ বুঝি আনন্দের ঠিকানা নিয়ে আসেন পৃথিবীতে l আনন্দ নিয়েই ফিরে যান সময় হলে l ঠিক তেমনি একজন, শ্রীমতি কৃষ্ণা মিত্র l আমার মেজমামীমা l মামী বা মামিশাশুড়ি, যাই বলা যাক যা কেন l নতুন বিয়ে হয়ে যে সব শাশুরীকুল আমাকে বড়ো আদরে, বড়ো যত্নে, লালন করে একান্ত নিজেদের করে নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মেজো মামিমা অন্যতমা l

অনেক বড়ো বড়ো গাছ ঘেরা যে বাড়িটিতে মেজোমামা ও মেজমামীমা থাকতেন, সেই আবহে গেলেই আমার কেমন মেয়েবেলায় বইতে পড়া কোনো ফার্মহাউসের কথা মনে আসে l চারিদিকে বিশাল সব গাছেরা মায়ের স্নেহে বাড়িটিকে ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখে l সকাল হলেই পাখপাখালির কিচিরমিচিরে ভরে ওঠে ওদের কাজকর্মের দিনগুলি l ছেলেমেয়েরা মায়ের বড়ো বাধ্য l সক্কাল সক্কাল তারা বেরিয়ে যায় সারাদিনের মতো স্কুল কলেজে l মেজোমামা আর্কিটেক্টের কাজের মাঝে যেটুকু সময় পান, হয় কোনো কিছু মেরামত করছেন, না হয় বাগানে ছোট খুরপি দিয়ে গাছের মাটি খুঁড়ে দিচ্ছেন একটু l মেজমামীমা সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী মূর্তি, স্নান সেরে সাধাসিধে শাড়ি পরে, পিঠে চুল ফেলে স্বামীকে চাটুকু দিয়ে যান বাগানেই l মেজোমামা এক গাল হাসেন l বালকসুলভ এক নির্মল হাসিমুখ নিয়ে বলেন – আবার বাগানে কেন গো? এই তো যাচ্ছিলাম ভেতরে, একবার হাঁক দিলেই হতো l মেজমামী হাত বাড়িয়ে দেন, চায়ের কাপটি, সঙ্গে কুকি, বাড়িতে বানানো l

আহ্হা, সেই কুকির, কেকের, গন্ধে ভরে থাকে বাংলো বাড়িটি l সে সব গন্ধে জারিত আমার যুবতীবেলা l বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই বুঝে ফেলি আজ মেজমাইমার কুকিং রেঞ্জে কি রান্না চলছে l সারাক্ষণ কিছু না কিছু হচ্ছেই সেখানে, আজ পিঠে, কুচো নিমকি, তো কাল পায়েস, দইবড়া l বাড়িতে পৌঁছতে পারলেই হলো l একপ্রস্থ রানীর আদর আমার বরাদ্দ সেদিন l বাড়িঘর ঝকঝকে তকতকে l ছেলেমেয়েরাও মায়ের মতোই সমান করিৎকর্মা যে l অথচ মানুষটি বোটানিতে পি এইচ ডি আর বিদেশে কর্মরতা ছিলেন বহুদিন l এমন লক্ষ্মীমন্তি সুগৃহিনী তিনি সে সব কথা না জানা থাকলে বোঝাই যায় না l

একদিন অমনি ল্যান্ডফোন বাজলো l বৌমা, কেক করতে শেখাবো তোমাকে আর স্বাতীকে, এসো l আমি তখন কম কম রান্না জানি l কোনোমতে শ্বশুরবাড়িতে ট্রেনিঙে আছি l ভয়ে ভয়ে মা দিদিমার থেকে রান্নাবান্না শিখে এসে এখানে তাক লাগিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাই l এমনি সময়ে এমন আহবান l তায় মেজমামীর মতো ভালো রাঁধুনির থেকে শেখা? আমি দৌড়লাম ওঁর বাড়ি l অবাক হলাম, যে রান্না করবার জন্য এপ্রনের ব্যবস্থাটিও করে রেখেছেন উনি l কেক বানানো হলো l অনুপান লিখিয়ে দিলেন, হাতে ধরে l আমাদের বাড়িতে তখন একটি ছোট বেকিং আভেন ছিল l ওই গোলমুখো বাজাজের l তাই সই l মেজমামী তাই বড়ো আভেনে না শিখিয়ে ওতেই শেখালেন, হাতে ধরে l ভাবতেই পারিনি, এমন সহজ ব্যাপার l আর বললেন, আজকের কেক কিন্তু তুমিই বানালে l ভালো শিক্ষিকার এই গুণ লক্ষ্য করলাম মন দিয়ে l সেদিনের সেই কেক বানানোর গন্ধ আমার স্মৃতিতে অমলিন l সে গন্ধের সঙ্গে ভেসে আসে কত টুকরো, কথা, গান, গল্প আর মামীদের বাগানের বেল ফুলের সুবাস l

মেজ মামীমার যে স্মৃতিভ্রংশের অসুখ করছে, তা বোঝাই যেত না l সবার মাঝে এক মুখ স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে বসে আছেন তিনি l তবু কখনো কখনো নিজের মধ্যে অবগাহন চলছে স্মৃতির অতলে l বেশ কয়েক বছর আগে, শ্বশুর মশাইয়ের শ্রাদ্ধে এসেছেন তিনি l বসে আছেন সবার মাঝে l কথা নেই বিশেষ l হেসে, কাছে গিয়ে, হাত বাড়িয়ে দিলাম l বললাম, কেমন আছো মামিমা? বললেন, ভালো আছি বৌমা, তুমি কেমন আছো ? অসুখের কথা জেনে, এতটা আশা করিনি l আমাকে চিনেছেন l সঙ্গে দাঁড়ানো কলেজে পড়া পুত্র কে দেখে বললেন, ও কে? আমার ছেলের কথা হয়তো ভুলে গেছেন, মনে করিয়ে দিলাম l বললেন, ও স্কুলে পড়ে না ? হয়তো অতীতের সেই দিনগুলোতে বাস করছেন এখনো l সেই বাড়ি, মেজোমামা, সেই রান্নাঘর, সেই কুকি, সেই বাদশা কুকুরের সব স্মৃতি আঁকড়ে ধরে … এ’সবের মধ্যেই l বুঝলাম অসুখের গভীরতা l কী ভাবছেন উনি বসে বসে l মুখমন্ডল জুড়ে প্রসন্নতা l এক চিলতে হাসি লেগে আছে ঠোঁটে l

হয়তো মেজমামীর মন পড়ে আছে সেই বাড়িতেই l মেজোমামা বানিয়েছেন গাজরের ওয়াইন l বাড়িতেই l নিচের এয়াটিকে রেখে এসেছেন জারে ভর্তি করে l দুজনে বাগানের গাজর তুলে, পরিষ্কার করে, ওয়াইন বানিয়েছেন বেশ তোড়জোড় করে l তারপর সেগুলিকে রেখে দেওয়া হবে বছরের পর বছর l হয়তো কখনো অতিথি এলে, বেরিয়ে আসবে একটি জার l আর মেজোমামা সমাদরে সে’সব পরিবেশন করবেন হালকা গর্বিত হাসিমুখে l মেজমামী ভাবতে থাকেন, আজ বাড়িতে গিয়ে দেখতে হবে, জারগুলো ঠিক আছে তো l মেয়ে স্বাতীকে তাড়া দিতে থাকেন, ও স্বাতী, তোর বাবার খাবার সময় হলো যে, বাড়ি যাবি না? হ্যাঁ রে? অথচ মেজোমামা গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর হলো l মেজমামীর যে সব পুরোনো স্মৃতি মনে থাকার অসুখ l

আজ মেজমামী চলে গেলেন ভোরের বেলাতে l শুনেছি আল্জ্হেইমারএ আক্রান্ত মানুষজন বাড়ির পথ ভুলে যান l মেজমামীও হয়তো পথ খুঁজে পাননি ঘরে ফেরার l হয়তো দেবযানের গল্পে যেমন, তেমনি আলোবাতাসে এক হাওয়াবাড়ি তৈরী করে নিয়েছেন মেজোমামার সঙ্গে কোনো নিশ্চিন্তপুরে l কুকি বানিয়েছেন, বাগান করছেন আগের মতোই l মেজোমামা চোখ বুজে হাসেন, কিগো, এতোদিনে সময় হলো ? মেজমামী চাঁদের হাসি হাসেন, ওমা আমি যে তোমার সঙ্গেই আছি l তোমাকে ছাড়া মাঝের এতগুলো বছর, তাই ভুলেই সেরে দিয়েছি যে l মনেই রাখিনি l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

“তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যতদূরে আমি ধাই …”

“তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যতদূরে আমি ধাই …”

তীব্র মনখারাপ আজ l কৃষ্ণাদি চলে গেলেন l

মনের আঙিনায় তাঁর ঢলঢলে মুখখানি l বড়ো টিপ্ পরিহিতা, স্নেহময়ী, মাতৃমুখী সেই উজ্জ্বল প্রতিভার অধিকারিণী, আমার গুরুদেব শ্রী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহধর্মিনী l নীরব, নিভৃত, গোপনচারিনী ওই মানুষটি রামানন্দদার রামকৃষ্ণমিশনের কোয়ার্টারটি আলো করে রাখতেন l পরপর দুটি ষ্টুডিও ঘর l সেখানেই রাখা থাকে আমাদের মাটিতে বসে ছবি আঁকার ডেস্ক, জলের চিনেমাটির বড়ো গামলা, সারে সারে l রামানন্দদা একটি ঘরে মাদুরে বসে আঁকেন l আমরা আঁকি কম l দেখি আর গল্প করি তাচ্চেয়ে অনেক বেশি l গল্প সব শ্রী রামকৃষ্ণের, কথামৃতের, শান্তিনিকেতনের l রামানন্দ আর কৃষ্ণাদি যেন দুই মহীরুহ, বটবৃক্ষ, অশ্বথবৃক্ষ, যাঁদের আশ্রয় করে আমাদের শিল্পযাপন l কৃষ্ণাদি স্মিতা, সদা হাস্যময়ী, মায়ের মতন l রামানন্দদা আকাশের মতো সুদূর প্রসারী l

ভারতীয় ভাষা পরিষদের একটি এক্জিবিশনে কি ছাই এঁকেছিলাম আজ আর মনে পড়ে না l তবে লাভের মধ্যে বাবা আলাপ করলেন যেচে রামানন্দদার সঙ্গে, আমার জন্যই l সে’খানে তিনি বিচারক ছিলেন l অতিশয় সজ্জন তিনি, বললেন, “পাঠিয়ে দিন, শিখবে l” সেই তাঁদের সান্নিধ্য লাভ l যতটা সময় ওঁদের সান্নিধ্য পেয়েছি, মনে হয়েছে এর মতো অমূল্য সময় জীবনে আর আসেনি l এরপরই বাবা হঠাৎ চলে গেলেন l হঠাৎই l পরদিনই ছুটে গেলাম ওঁদের কাছে l ওঁদের সুন্দর সাজানো ছোট্ট একরত্তি ঘরে সমস্ত বুকভাঙা কান্না ঢেলে দিলাম l কৃষ্ণা দি, তার পরেও কতবার যে মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেন l বলতেন, “তুমি বড়ো, তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে l”

খুব কম কথা বলেন কৃষ্ণাদি l রামানন্দদা ভরিয়ে দেন গল্প বলে ওঁর যত না-বলা l কিন্তু ওঁর ওই হাসিতেই যে অনেক কিছু বাঙময় হয়ে ওঠে l কি সুন্দর করে সাজেন উনি l কেবল মনে হয়, দুজনে দুজনার আদর্শ পরিপূরক l ব্রাশ আর জলের বাটি ধুতে গেলে, আস্তে আস্তে কথা বলেন কিছু l আমার জীবনের পাওনা সে সব l সে সময় ক্যামেরা ফোনের বাড়াবাড়ি ছিল না তাই ছবি তোলা নেই l কিন্তু ওঁদের সব ছবি মনের তুলোট কাগজে আঁকা হয়ে আছে যে l

জল রঙের ছবি, ওয়াশে, হ্যান্ড মেড পেপারে l রামানন্দদার শেখানো l কৃষ্ণাদির ছবি দেখে অনেক অনুপ্রেরণা, আজও যা অমলিন l কৃষ্ণা দি বড়ো রঙিন মনের ছিলেন l পেলব রেখার মতো তাঁর চিন্তাশৈলীর গতিবিধি l কি শৈল্পিক, কি চমৎকার l রামানন্দদার মতো গুণী শিল্পীর সঙ্গে থেকেও কি স্বাতন্ত্র তাঁর রেখায়, তাঁর রঙের ব্যবহারে, তাঁর তুলির টানে l

কৃষ্ণাদি বড়ো অন্যরকমের ভালো l মাঝে রামানন্দ দার সঙ্গে ফোনএ কথা হয়েছিল, কিছু বছর আগে l পিতৃবৎ তিনি, তাই জীবনের পলিমাটি-সঞ্চিত মনের দুঃখ কষ্ট উজাড় করে দিয়েছিলাম সেই কলেজবেলার মতোই l কৃষ্ণা দি ছিলেন পাশে, তাঁর নিবিড়, নীরব অস্তিত্ব নিয়ে, অন্য সব দিনের মতোই l

শিল্পীর মৃত্যু নেই l কৃষ্ণা দি রয়ে গেলেন স্বামীর পাশে, অটুট গৌরবে l তাঁর আঁকায়, তাঁর স্মিতসুন্দর হাসিতে l

জানি, রামানন্দদা বলবেন ঠাকুরের শ্রীরামকৃষ্ণের মতো করেই, এ ঘর থেকে ও’ঘরে যাওয়া l
এ যাওয়া কোনো যাওয়া নয় l

© অপর্ণা গাঙ্গুলী

(ছবি : আন্তর্জাল)
**সঙ্গের ওই ঢেঁকিশালে পাড় দেওয়া ছবিটি আমাদের সামনেই আঁকা, সেই সময়ে …

পড়াঘরের জানালা

অনলাইন ক্লাস এক মজার কান্ডকারখানা l কোন সুদূরে বসে আছে এক ছাত্র, তাদের সেখানে দিন কিংবা রাত, সক্কাল কিংবা দুপুর l তাদের সময়ে সময় মিলিয়ে আমিও হাজির হয়েছি সেই পড়াঘরের ঠিকানায় l সে ঠিকানা আর কিছুই নয়, অনেক নম্বর আর অক্ষরের সমষ্টি সেই একমাত্র ইউ আর এল, যেখানে আজকের পড়াশোনা হবে l সে এক ভারী মজার ক্লাসরুম কিনা l কী নেই সেখানে, ব্ল্যাকবোর্ড থুড়ি হোয়াইটবোর্ড, পেন্সিল, ইরেজার, লাইব্রেরি, মজার স্মাইলি, রাগ দুঃখের ইমটাইকোন, শেপস, ওয়ার্কশিট আরো কত কী কী যে l তবে কী যেন নেই, কী যেন নেই – ওহ হ্যাঁ, ডাস্টারের ধুলো নেই, চক নেই, সত্যিকারের বই নেই, মাস্ক নেই, জানলা অনেক আছে বটে, কিন্তু সে তো পড়াশোনার জানালা, যেখানে সব হিজিবিজি ভয়ঙ্কর রকমের লেখাপড়া চলে ক্রমাগত l কিন্তু সেই জানলাটা নেই, যেখান দিয়ে মন পাখিটা ফুড়ুৎ হতো কোনো ঝুমবৃষ্টিবেলাতে, স্কুলের মাঠের পারে, ওই একলা বকের ডানায় l তবুও টমিন সেইরকম একটা জানালা খুঁজে পায় বৈকি l ক্যামেরাতে যাদের পড়াই না, তাদের বড়ো সুবিধে কিনা l অনুমানে বুঝে নিতে হয় সে সব l পড়তে পড়তে পড়তে পড়তে হঠাৎ তার গলা আস্তে থেকে আস্তে হতে হতে মিলিয়ে যায় কোন সুদূরে l বুঝি l ছাত্রের জানালার কাছে কোনো বুনো কাঠবেড়ালী নির্ঘাত তার ফেলে যাওয়া বাদামটুকু কুড়িয়ে নিতে এসেছে l আর তাই দেখছে সে, অবাক হয়ে, নির্নিমেষে l তা তো দেখবেই, আমি হলেও তো দেখতাম, নয়? বুঝি সে’সব, বুঝে নিতে হয় …

ওর ভাষাতে বলি, “কি করছিস রে ছেলে? কাঠবেড়ালী চলে গেছে? না আছে এখনো?”

ছাত্র অবাক হয় … “উউউউউউ তুমি কি করে জানলে টিচার? কাঠবেড়ালী এসেছিলো …”

বলি, “টিচার কিনা, ও’সব একটু জানতে হয় …”

আর যারা ক্যামেরায় পড়ে, তারাও জানালা দিয়ে বেড়াল কুকুর শালিখ চড়ুই দেখে, একটু বড়োরা বন্ধুর মেসেজের উত্তর দেয় l বুঝি l বুঝে নিতে হয় l কারণ সেই সময়টুকুতে তারা ক্যামেরাটি বন্ধ করে রাখে l একটু পরে এসে সোনাহেন মুখ করে বলে, “নেটওয়ার্ক ইস্যু, ম্যাম l”এসব তারা বলে বইয়ের পাতায় মুখ রেখে, চোখে চোখে তাকিয়ে নয় l বুঝি, বুঝে নিতে হয় l মাঝে মাঝে বলি, পড়তে পড়তে যদি একটু ব্রেক লাগে বোলো, আমি না হয় আরো পাঁচ-সাত মিনিট বেশি পড়িয়ে দেব, কেমন? গলাতে যতটা সম্ভব ভ্যানিলা আইসক্রিম মাখিয়ে রাখি তখন l কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না l আবারও সেই ক্যামেরা অফ, নেটওয়ার্ক ইত্যাদি l

বুঝি আমি, বুঝে নিতে হয় l

এ হচ্ছে সবসময়ের ক্লাস l ডেমো ক্লাসের মজা অন্যরকম l সে’খানে বাবা মায়েরাও উপস্থিত থাকেন l আদ্যোপান্ত জরিপ করেন, দেখি তো এই টিচারের জ্ঞান কদ্দুর, কেমন চলনবলন, এর ক্লাস নেওয়া যাবে কিনা l ডেমো ক্লাসে বাবা, মা, ছাত্র বা ছাত্রী, তিন জোড়া চক্ষু জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে (পড়ুন, “মাপে”) l বাচ্চাদের ওপর বাবা মায়েরা স্বভাবতই খুব বেশি সংরক্ষণশীল l প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে বাচ্চা একটু চুপ থাকলেই দু’দিক থেকেই বাবা এবং মা তাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করার জন্য মুখিয়ে ওঠেন l বুঝি, এইসব ব্যাপার বুঝে নিতে হয় l তবে এ ব্যাপারটা পছন্দ করি না l ছোট থেকে ছেলেকে খুব স্বাধীনভাবে বড়ো হতে দেওয়া মা আমি l নিজে শিখুক, এই ধারণাতে বিশ্বাসী l না পারলে পরের বার পারবে, শিখে নেবে, শিখতে চেষ্টা করবে l কিন্তু আমি হলাম গে, ছাত্রটিরই টিচার, তাও হবু টিচার, নাও হতে পারি l বাবা মায়ের তো নয় l তাই বাপমা এ যাত্রায় পরিত্রাণ পেয়ে গিয়ে ছেলেকে সাহায্য করতে থাকে l ভুল বললে, শুধরে দিতে হয় l তারপর, টিচারকে বেশ পছন্দ হলে সেই ছানাটি আমার ক্লাসে ঢুকে পড়ে l তারপর? তারপর আর বাবা মা ফিরেও দেখেন না l অবশ্যই l আবার কেউ কেউ একটু বা দেখেন l সে’সব বোঝা যায় বাবা মা এবং টিচারের পাক্ষিক সাক্ষাৎকারে l

তা এই সব গপ্পো … আজ কী হলো বলে ইতি টানবো এ লেখায় l ছেলেটি বেশ চটপটে l থাকে ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া l বেশ লেখে, বলে l ইংরিজি অনুপ্রাস অলংকার পড়ে সে এমন এক চমৎকার গান লিখে ফেললো, তার বাগানের একটি বৃদ্ধ পাইন গাছ আর এক ফিঞ্চ পাখির সখ্যতা নিয়ে, যে আমি চমৎকৃত l প্রতিভা l আমি কেউ না, একটু সাহায্যকারী l ক্লাসেই সে গান লিখে, গেয়ে শুনিয়েও দিলো দু’কলি, গিটার বাজিয়ে l সে নাকি তার স্কুলের ব্যান্ডে সেটি পরিবেশন করবে l সে গানটিতে সে হরেকরকমের “ফিগারস অফ স্পিচ” প্রয়োগ করেছে l আমি ধন্য হয়েছি পড়ে এবং শুনে l ওরা কেমন টগবগ করে লেখে, ফটফট করে বলে, তড়বড় করে এগিয়ে যায়, তাই ভাবি l

খোলা জানালা না থাকলে কি এ’সব হয়?

থাক, খোলা থাক, পড়ার ঘরের জানালা l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

মা

মা l

পৃথিবীর সবথেকে প্রিয়তম শব্দটি l কবে “মা” বলতে শিখেছিলাম জানিনা l কবে মাকে চিনতে শিখেছিলাম তাও মনে নেই l তবু যেই একটুকু জ্ঞানের উন্মেষ হলো, বুঝলাম, ওই মানুষটি, সদ্য-পাটভাঙা-ডুরে শাড়িটি পরে যে আমার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, সেই আমার মা l তাঁকে খিদে পেলে, ঘুম পেলে, মনের কষ্ট হলো, দুঃখ হলে, রাগ অভিমান হলে সবটুকু বলা যায় নির্দ্বিধায় l আসলে মাকেও সন্তানের জন্যে সেই জায়গাটুকু করে দিতে হয় যে l তা মা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, দেখো আমার এই মাথার পেছনে, দুটো বড়ো বড়ো চোখ আছে, যা তোমরা দেখতে পাও না l তা বলে, কিছু অন্যায় করলে আমাকে যদি না বলো, আমি ঠিকই টের পেয়ে যাবো মা l যা হোক, আমার আর বোনের ছেলেমানুষ মন সে সবে আদ্যন্ত বিশ্বাস করেছিল l আমাদের চারচোখো মায়ের মাথার পেছনের চোখ দুটিকে সেই থেকে ভয় ও সম্মান করে এসেছি চিরকাল l

বিকেলবেলাতে গা ধুয়ে আবার একপ্রস্থ পরিষ্কার শাড়ী জামা পরে, ধুপ ধুনো দেখিয়ে মা আমাদের গান শেখাতে, পরে পড়তে বসতেন l মায়ের চারপাশে এমন এক স্বর্গীয় সুষমা খেলে বেড়াতো যে মাকে আমার অমরচিত্র কথার বইতে দেখা লক্ষ্মী দেবী মনে হতো l মা কাজ করতেন অনর্গল, কথা বলতেন ভারী কম l মা শিখিয়েছিলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলতে নেই l মায়ের দুই মেয়ে, পুত্র সন্তান না হওয়াতে মায়ের একটু ক্ষোভ ছিল কিনা বলতে পারি না l তবু সে সব তিনি কখনোই দেখান নি মোটেই l সমদর্শী মা দুই মেয়েকে সমান ভাবে মানুষ করেছিলেন l বাবা চলে গেছেন খুব তাড়াতাড়ি l অমন ভালোবাসার স্বামী পেয়ে হারিয়েও মা ভেঙে পড়েননি বাইরে l হয়তো আমাদের সাহস যোগাবার জন্যই l বোনের পরীক্ষার মাঝেই বাবা চলে যাওয়ার বিপত্তি l মা গিয়ে দাঁড়িয়েছেন পরীক্ষার হলের বাইরে l প্রবল বৃষ্টিতে যখন কলকাতা শহর ভাসছে তার মধ্যে আমাকে নিয়ে গেছেন বি এড পরীক্ষা দিতে l মাও ভিজে চুপচুপে l আমিও l তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, শ্রী শিক্ষায়তনের প্রফেসরদের মাতৃসত্ত্বা জাগরুক হয়ে উঠেছিল আমার অসহায়, বিধবা, বিপন্ন, চরম আর্দ্র মায়ের চেহারাটি দেখে l মাকে সারাদিন জন্যে ছোট স্টাফরুমের একদিকে জায়গা করে দিয়েছেন বসবার l আর আমাকে পরীক্ষা শেষে, বলেছিলেন, এমন মা তোমার, মুখ রেখো বাবা l

এম এ তে যেদিন সুযোগ পেলাম, যাদবপুরে, মা সঙ্গে ছিলেন l যশোধরা দি বললেন, তোমার হয়ে যাবে l মা বললেন, সুযোগ পেলে, তার সদ্ব্যবহার কোরো l গায়ত্রী দি ছিলেন ওই ঘরেই l পরে বলেছিলেন, তোমার মাকে আমার বড়ো ভালো লেগেছিলো l মনে পড়ে l মা সারাদিন কেমন আমার দু বছরের ছেলেটাকে দেখভাল করে আমাকে এম এ পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন l তখনকার মায়ের বয়সে এখন পৌঁছে বুঝি, কাজটা কিছু সহজ ছিল না l এসব কথা এখন বলছি, হয়তো সেভাবে মাকে বলা হয়ে উঠেনি তখন l

মায়ের কাছে পেয়েছি, ধৈর্য্য, সহ্যশক্তি, নীরবতা, দয়া, ক্ষমা, তিতিক্ষার মতো অমূল্য সম্পদ l
আজও বৃষ্টি-ভেজা দিনে, যখন জানালার পাশে বসে থাকি, চুল ভিজে যায় আনমনে, মনে হয় মা যদি আর একবার বলতেন, ওমা ঐভাবে বসে বসে চুল ভেজালি, জ্বর হবে দেখো l একলা রাতে “মা মা” বলে কাঁদতে ইচ্ছে করে যখন তখন এক ঝাঁক তারার মধ্যে মাকে খুঁজে পাই না তো l মা বলেন, ধুর বোকা, এই তো আমি, তোরই মধ্যে মা হয়ে থেকে গেছি রে l কোথাও যাইনি আমি l এই তো, হৃদয় ছুঁয়ে দেখ দেখি l

আসলে, মায়েরা থেকেই যায় l দুপুরে আলোয়, পায়রাদের খেতে দিয়ে… ছেলেমেয়ের ফোন পেলে হৃদয় যখন মুচড়ে ওঠে, কবে দেখতে পাবো ওদের ! রাস্তায় টমি কুকুরটাকে গাড়ি ধাক্কা দিয়ে গেছে, খুব কষ্ট ওর, ওকে একটু দুধ বিস্কুট দিয়ে আসি… মহাদেব আর ওর বৌ রাস্তায় থাকে, দূর থেকে দেখেই মা মা করে ছুটে আসে, ওদের খাবার দিয়ে কুশল খবর নিই … সব মায়েদেরই মতন, আলাদা কিছু নয় l

এই ভাবেই মায়েরা আবহমান কাল ধরে বেঁচে থাকে l

অমৃতা ওঁরা, সব মায়েরাই l ওঁদের চরণে আভূমি প্রণতি রেখে যাই l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

আনন্দ

आनन्दाद्ध्येव खल्विमानि भूतानि जायन्ते  

आनन्देन जातानि जीवन्ति 

आनन्दं प्रयन्त्यभिसंविशन्ति ॥

(তৈত্তিরীয়োপনিষৎ)

রোজ সকালে ঘুম ভেঙে বাইরে, বাগানে টিয়াপাখিদের ট্যা ট্যা শুনতে পারি l আজকাল ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে হাসে, সূর্যমুখী ফুলের বুক থেকে বীজ খুঁটে খায় আর মনের আনন্দে দোল খেতে থাকে l ওরা এক একটি আনন্দের উৎস l প্রাণে কোনো ভয়ই নেই l এই যদি উত্তিমদাদা মোটা তোয়ালে পাকিয়ে ওদের ধরতে আসে, তাহলেও না l মালিদাদা ওরা এলে কাছে যায় না, পাছে ওরা উড়ে যায় l উত্তিমকেও কাছে যেতে দেয় না l হেই হেই করে তাড়া মেরে ভাগায় l না হলে উত্তিমদাদার খুব ইচ্ছে একটা দুটো পাখি ধরে এনে রাখে, খাঁচায় l আর সেই সুদূরে মুলুক যাবার সময়ে ওর কচি বৌয়ের জন্যে একটি সুন্দর চিড়িয়া নিয়ে যায় l বৌয়ের মুখে হাসি ফোটে l কিন্তু মালি দাদার জন্যে সে’সব হওয়া সহজ নয় l আমিও চাই না l কী হবে ওই মুঠো মুঠো আনন্দকে খাঁচায় বন্দী করে একরাশ নিরানন্দকে ডেকে এনে? উত্তিমদাদা ভোজপুরি গানা গাইতে গাইতে রান্নাঘরে গিয়ে সেঁধোয় l সকালের নাস্তা তৈরী হবে l

আমি ভোর ভোর জেগে উঠেছি l আজ আবার ছুটির দিন তাই বাড়ির সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমোয় l আমি টিয়া চন্দনাদের সঙ্গে মিতালী পাতাতে চেষ্টা করি l ওদের কাছে জীবনটা আনন্দই আনন্দ l মিস ইমানুয়েলের স্কুলে যাওয়া নেই, পড়াশোনা নেই, মায়ের বকুনি নেই, খালি নিরন্তর আনন্দ l রাশি রাশি আনন্দ ওদের চারিভিতে l এই ভাবে ওরা যেন এক একটি মূর্ত “আনন্দ” হয়ে উঠেছে আমার চোখের সামনে l আমি দু হাত বাড়াই বারান্দার গ্রিলের ভেতর থেকে l বাইরে যাওয়ার হুকুম নেই আমার l ইচ্ছে আছে l টিয়ারা আমার ভয় পায় না l কলকল করে বলে ওঠে, ও মেয়ে, তুমি বদ্ধ কেন, এই দেখো না আমরা কত মুক্ত, কত আনন্দ আমাদের l ওগো মেয়ে, “আমরা এমনি এসে ভেসে যাই” l তাই না তাই l আমার একটু মনখারাপ হয় l ওরা বলেই চলে, এই তো দ্বিজ মালিদাদার বাগাবের সূর্যমুখীর বুক খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়ে আমরা চলে যাবো নদীর পারে l সেখানে বুক ভরে খাবো নদী জল l তারপর ডানা মেলে, গঙ্গার বুকে বুক ঠেকিয়ে উড়ে যাবো ওই সুদূরে সেই তির্পূর্নির ঘাট, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে কোন দিকশূন্যপুরে l আমি হাঁ করে ওদের কলকলানি শুনতেই থাকি l হায় গো, অমন করে আমিও যদি ….. শুধু বলি, চলেই যাবে? ফিরবে না আর? ওরা ঝরঝর করে ডানা ঝাপটায়, খলখল করে হাসে l হ্যাঁ হ্যাঁ ফিরবো তো l ঐখান থেকে মুঠি মুঠি আনন্দ কুড়িয়ে নিয়ে বুকে করে আবার এসে দোল খাবো তোমাদের বাগানে, কাল সকালে l কেমন, ভালো না ?

এই না বলতে বলতে এক রাশ সবজে মেঘের মতো টিয়ারা উড়ে যায় অন্য দেশে l ওদের উড়ান আমি বেবাক তাকিয়ে দেখি l ওরা চলে গেছে বটে l কিন্তু ফেলে গেছে রাশি রাশি আনন্দ l ওই তো ফুলে, পাতায়, বনে, বাগানে, পেরজাপতির ডানায়, গাছে, মাটিতে, রিনরিন করে বাজছে আনন্দবীণ l আমি দু হাত মেলে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকি l মন ভালো l আর কোনো দুঃখ নেই l পড়াশোনা করবো, মায়ের কথা শুনবো, খুব ভালো হবো আমি, ওই টিয়াদের মতো l

উত্তিমদাদা হাঁক পাড়ে, খুকিদিদি খানা খাবে এসো l মা ডাকছে l
মা বলেন, ও কী রে l তোর মুখ চোখ অত চকচকে কেন মা এই সাতসকালে? কী হয়েছে ?

আমি এক গাল হেসে বলি – “আনন্দ” l

কাগজের নৌকো

আমাদের মেয়েবেলাগুলো ছিল ভীষণ মায়াবী, নদীর গন্ধে ভরা, এলোমেলো l সেই সব সময়ে থাকতাম হুগলি নদীর ধারে আর লঞ্চে চেপে পারাপার করে পড়তে যেতাম চন্দননগরের কনভেন্টে l চৈত্র বৈশাখের বিহানবেলায় যখন উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসতো দৈত্যের মুখের মতো কালো মেঘেরা সব, ছুটি হতো সেই সময়েই l আমাদের সাবি মাসিরা ইস্কুলের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো ছাতা, আরও একপ্রস্থ টিফিনের ব্যাগ, সরবতের বোতল নিয়ে l সেই স্কুলবেলা থেকেই হাত ধরে জীবন-নদীতে-পারাপার-করিয়ে-দেওয়া এই সব মাসিপিসিদের অবদান অনস্বীকার্য l আমাদের নীল প্লিটেড স্কার্টের পকেটে থাকতো কাগজের নৌকো l রাশিরাশি l ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কাগজে তৈরী l তাদের কোনোটার ছইওয়ালা, কোনটা এমনি l

স্টিমার যখন মাঝ নদীতে, তখন আমাদের ভারী মজার একটা খেলা ছিল l আমরা একটা একটা করে নৌকো ছাড়তে লাগতাম জলে l আর সেই সব নৌকোরা আমাদের যত স্বপ্নকে নিয়ে কেমন ভেসে যেত দূরে, দূরে l আমরা ডেকে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকতাম যতদূর চোখ যায় l আমাদের সব ইচ্ছেগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে হুস করে পাঠিয়ে দিতাম ওদের সঙ্গে l তিরতির করে ছোট বড়ো ইচ্ছেগুলোকে নিয়ে ভেসে যেত ছই ওয়ালা কাগজের নৌকো l তা একবার হলো কি, লঞ্চ খারাপ থাকাতে নৌকো করে যাওয়া আসা চলছে l আমরা জুতো মোজার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে দিব্য পা ঝুলিয়ে বসে আছি কিনারে l মাঝি দাদারা সাবধান করছে l আর সাবি মাসিরা ভয়ে কাঠ হয়ে আমাদের ভয়ঙ্কর বকুনি ঝকুনি দিচ্ছে l আনন্দের আতিশয্যে একটু বেশি ঝুঁকে নৌকো ভাসাতে গিয়ে হলো গোলমাল l ঝপাস করে পড়ে গেছি জলে, এক্কেরে মাঝনদীতে l ওদিকে কালবৈশাখী উঠেছে ঘোর l অমনি পাশের এক নৌকো থেকে দুই মাঝি জলে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার না করলে কী যে হতো সে যাত্রায় বলা যায় না l হাতে তখনও মুঠি করে ধরা নীল কাগজের নৌকো l আর প্রচন্ড এক চপেটাঘাত সাবি মাসির হাতের l তাই তো বলি, সেই কাগজের নৌকোর সঙ্গে বাঁধাছাঁদা হয়ে থাকা সে এক রঙ্গীন গপ্পো l আজ রত্নাদি, তোমার অনুপ্রেরণাতে মনে উঠে এলো l তারপর নৌকো ভাসিয়েছি, মাঝ নদীতে আর নয় l ছোট খাটো খাল, বিল, পুকুরে l

জীবন তরণী ভাসিয়ে এগিয়ে চলেছি স্রোতের টানে l এ সব পারাপারে, বয়ে চলায়, দম লাগে, লাগে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সবার জন্যে ভালোবাসা l পেরেছি হয়তো … ভেসে চলার সেই মন্ত্র,  মেয়েবেলার সেই লাল, নীল নৌকোরা শিখিয়ে দিয়েছিলো বলেই না !

©অপর্ণা গাঙ্গুলী

সেকেন্ড ইনিংস

বয়স বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু, কনুই, পিঠ, ঘাড়, পা, কোমর সবকিছুই যে এমন বৈরীতা শুরু করবে কে বা জানতো l সেই মেয়েবেলা থেকে যারা সব একশনে ভালোই সঙ্গ দিয়ে এসেছে, এখন তাদের জন্যেই যদি ট্রাক্শন ঝুলিয়ে বাড়ি বসে থাকতে হয় তো কেমন লাগে? শুধু কি এরাই? আর চোখ, গাল, কান, দাঁত, মাথা, গলা এরা নয়? এরাও তো কথামতো ঠিক চলছে না তো l এই তো সেদিনই দুই সমবয়েসী বন্ধু বাচ্চামি করতেই জু গার্ডেনএ গেলাম l ওরেবাবা ফেরবার সময়ে তো ঝকমারি l ওভারব্রিজের এস্কেলেটর চড়তে গিয়ে নিচে তাকাতেই মাথা বাই বাই করে ঘুরে গেলো l আমার আবার ভার্টিগো কিনা l কোনোমতে হাত ধরাধরি করে নিচে নেমে দু কাপ চা খেয়ে তবে স্বস্তি l তবু এতো তাড়াতাড়ি বয়স বাড়ছে ভাবতে দিলেই হলো? কভি নেহি l দরকার মতো গ্রিন টি, টমেটো, কাঁচা সবজি, এলো ভেরা জুস্, ইয়ে টিয়ে দিয়ে জম্পেশ খাবার রুটিন বানিয়ে চলতে থাকছি l ভয় কি, কোরোনার ভ্যাকসিন যখন এসেই গেছে তখন দ্বিতীয় ইনিংস খেলবার জন্যে তৈরী হই l এখন তো হাটে বাজারে একটাই স্লোগান গো – খেলা হবে l

তা হোক, তা বলে এই মঙ্গলবার, নিৰ্মিষ্যি রান্নার দিনে, রান্নাঘরে ঢুকে রান্নার ফাঁকে নাচতে ইচ্ছে হলো ? না না রান্নাঘরটা প্রশস্ত l ঠাকুরের দয়ায় একটা ছোটোখাটো মাঠের মতোই রান্নাঘর আমার l নব সংযোজন l চারিদিকে আলমারি, গ্যাস, রান্নার সরঞ্জাম, আর মাঝে ওই নাচার এরেনা l তরকারি চাপিয়ে দিয়ে জুম্বা প্রাকটিস এর আদর্শ স্থান l কাঁচকলার কোপ্তার তরকারি বসিয়ে দিয়ে এই তো অবকাশ l ওরে বাবা, পাশের বাড়ি থেকে রেডিমেড গানও ভেসে এলো যে গো l ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান l’ আমি বেশ আয়েশ করে দুলে দুলে নাচতে থাকি l ‘বাঁধনছেঁড়া প্রাণ’ … মুড্ এসে গেছে l এতো ভালোলাগা রোজ হয় না l এই রেশটাকে নিয়েই থাকতে চাই l একটু লাগছে যেন হাঁটুতে l ও কিছু না l আমি ঘুরে ঘুরে নেচে যাই l বাড়িতে কেউ নেই l গুগল জানে ওর মায়ের মাথার ব্যামো, কিছু বলবে না l এর পরের গান ‘ফাগুনের মোহনায়’ … স্পিড বাড়ে, আমি বিহুর ভঙ্গিতে হাত মাথায় তুলে নাচি তাল ঠুকে ঠুকে l রঙ্গিনী বিহুর নেশায় বেশ মাদকতা আসছে, এমন সময় নাকে আসে কি যেন গন্ধ l সর্বনাশ, তলা ধরেছে l

যাকগে, ভাগ্যিস এখানেই ছিলাম, তাই বুঝতে পেরেছি l গ্যাস বন্ধ করে খুশি খুশি মুখে বসে থাকি কিছুক্ষণ l

হাঁটুর ব্যথা যেন একটু কম, কোমরের ব্যথাও l কি আনন্দ গো! সহসা যেন বয়স কমে গেছে আর শরীর মনও কেমন চনমনে হয়ে উঠেছে দেখো l ছোট একটা পরামর্শ, একটাই জীবন, হেসে-খেলে-নেচে-গেয়ে নাও l দেখবে ব্যথা বেদনা, মনের বা শরীরের, এক মুহূর্তে উধাও l

তাহলে আর কি? সেকেন্ড ইনিংস খেলতে নেমেছ, লেগে পড়ো l খেলা হবে l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

নারী

ঠাম্মা যখন পান খাবার পর আঁচল দিয়ে ঠোঁটের দু’পাশ মুছতেন, খয়েরের রসে রেঙে থাকতো তার সুকোমল ঠোঁট, নারীত্ব প্রকাশ পেতো l ঠাম্মা মুখ ফেরাতেই তাঁর নাকের হীরের নাকছাবিটি ঝিকিয়ে উঠতো দুপুরে আলোয়, আচার রোদে দিতেন ছাদে যখন l ওই মেজো বাবু এলেন, বলে আলতো হাতে ঘোমটা তুলতেন মাথায়, দাদু বেরিয়ে ফিরলেই l অপরিসীম এক নারীত্ত্ব মূর্ত হয়ে উঠতো তাঁর ভঙ্গিমায় l শ্রদ্ধা l

দিম্মি মাথা ঘষে অল্প সিঁদুর লাগাতেন সিঁথিতে, পায়ে দিতেন আলতা আর তারপর একটা সাধারণ লালপেড়ে শাড়ি পরে হেঁটে যেতেন মন্দিরে l নারীত্ব শব্দটি তাঁর জন্যেই সৃজিত মনে হতো তখন l দিম্মি গরীব আতুরকে দরজায় ডেকে চুপিচুপি খাবার দিতেন l জল দিতেন কাকপক্ষীকে খুব গরমের দিনে l নারীর সবটুকু দয়া উজাড় করে দিতেন এই সব ছোট ছোট কাজে l দয়া l

মা উঠে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে l বাবার সৎকার হয়েছে কিছু আগে l ঝলমলে শাড়ি গহনা বড়ো লাল টিপের মা থেকে এক লহমায় দীনহীন কালোপেড়ে সিঁদুরহীন বৈধব্যের বেশে এ কোন মা l মা নির্বিকার, স্তব্ধ l বোনের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় বললেন একবার, তুমি পরশু পরীক্ষা দেবে মা, আমি যাবো তোমার সঙ্গে … l শক্তি l

ছেলে হয়েছে সন্ধ্যে সাতটায় l নরমাল ডেলিভারি l এমন মা ও দেখিনি বাপু l অমনি রাজ্যের খিদে আর ঘুম জড়িয়ে এসেছে শরীর জুড়ে l কোনোমতে কপকপ খেয়ে ঘুমিয়ে গেছি l অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল হলো, ও রে, আমার তো ছেলে হয়েছে l একবার দেখতে পেলে হয় l যেই না ভাবা, অমনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি l শীতের রাতে গোলাপী তোয়ালে মোড়া সেই স্নেহের পুত্তলি l শিশুবেলার গপ্পের বইয়ের জেরিমি জো, পুতুলের মতোই l কোথা থেকে বাঁধ ভাঙা জলের মতো একরাশ মাতৃত্ব তড়বড়িয়ে এলো যে …. ওই শুরু … l মাতৃত্ব l

ছেলে যখন তাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো, তখন সে বাঁকানো শুঁটি, বিনুনি দু’টি এক বছর পনেরোর কিশোরী l পুটপুটে চোখ আর এক গাল হাসি l আমার সমস্ত মাতৃসত্ত্বা দিয়ে ওকে বরণ করে নিলাম l মেয়ে না থাকার দুঃখ ঘুচলো অবশেষে l সেই মেয়েকে আস্তে আস্তে নারী হয়ে উঠতে দেখলাম চোখের সামনেই l পুত্রের বিবাহের পর, লক্ষ্মীমন্তী ঘরের দরজায় পা রাখলেন l আমি দেখলাম সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নারায়ণ দাঁড়িয়ে দরজায় l বরণ করে ঘরে তুলি শাঁখ বাজিয়ে l দেবীত্ব l

নিত্যদিন আসে মালিশওয়ালী ভারতী l দু হাত ভরে সেবা করে যায় সবার l ভারতী ওর সংসারের জন্য প্রবল খাটে তবু মুখের হাসিটি অমলিন l শুধু মালিশ নয়, এটা ওটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে করে দেয় ও l দু’টি বেশি পয়সা হলে, ছেলেমেয়েদের মুখে মাছ দুধটুকু জোগানো যায় l ওর নরম হাতের সেবায় কত মা বোন প্রাণ পেয়ে ভালো হয়ে ওঠে তার ইয়ত্তা নেই l ভারতীদের নারী জীবন ধন্য l ওরা সেবা করতেই আসে l সেবাশুশ্রূষা করে দিনের শেষে ঘরে ফিরে যায় কর্ম শেষ হলে l ওরা ঈশ্বরের প্রতিভূ l সেবা l

মায়ের পার্বতী পিসি বালবিধবা l তাঁর নাকি মাছের ‘পরে লোভ ছিল l নিজ্জলা একাদশীর দিন, সে নাকি ঠারে ঠোরে হিংসে করে দিম্মিদের কথা শোনাতো l মায়ের পার্বতী পিসি অদ্ভুত ছিলেন l চাঁদের আলোয় দু হাত মেলে ছাদে নাচতেন ঘুরে ঘুরে l দেখে মনে হতো তাঁর পাখা গজিয়েছে l বনবাদাড় খুঁজে কী কী সব জড়িবুটি নিয়ে আসতেন পার্বতী পিসি l খলএ মেড়ে নিয়ে তা দিয়ে কী কী সব ওষুধ বানাতেন আর চমৎকার ফল হতো তাতে l সবাই বলতো, পার্বতী পিসি পাগলী l আমি ভাবতাম, ওর যেন কী একটা গভীর দুঃখ আছে l পার্বতী পিসি তাঁর ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঘর ছেড়ে কোথায় উধাও হলেন কে জানে l আর ফিরলেন না l তখন কেউ বললো, পাগলী, কেউ বললো ডাইনি, কেউ বললো বেচারী l আমার কিন্তু একটাই বিশেষণ মনে এলো l ঈশ্বরী l

অপর্ণা গাঙ্গুলী
নারী দিবস, ২০২১
ছবি : শ্রী বিকাশ ভট্টাচার্য্য (আন্তর্জাল)

জাদু কা ঝাপ্পি

হেমন্ত পেরিয়ে শীত ছুঁই ছুঁই খ্যান্তপিসির এখনও অদ্ভুতুড়ে ভাবটা বাপু কাটলো না l অন্তত ধূর্জটি পিসেমশাই আর হরিমতি বেড়ালনী এই ব্যাপারে সহমত পোষণ করে l না করে আর উপায় কি বলো? এই যে পিসি যখন তখন যা তা যাচ্ছেতাই কান্ডকারখানা ঘটিয়ে ছাড়ছেন, তার মূলে তো ওই হাবিজাবি ম্যাজিক কিনা l তা সে হাবিজাবিই বলো আর ইয়েই বলো, সেই যে জোছনা মজলিশে, আস্ত একখানা রান্নাঘর বানিয়ে নিয়ে খ্যান্ত সব্বাইকে তাক লাগিয়ে ছেড়েছিলেন কিনা, সে গপ্পো তো কারোই অজানা নয় কো l তা সে তখন সঙ্গে ছিল পিসির যত দূর আর কাছের সম্পর্কিত স্বর্গত, অশরীরী আত্মীয় পরিজনেরা l কিন্তু এবার যে স্বয়ং এক মনিষ্যি l নাম তার কেবলরাম গড়গড়ি l বলবো কি, এই প্রথম ফাল্গুনে সেই সুদূর কেষ্টনগর থেকে তিনি রেলগাড়িতে চেপে শুধুমাত্র খ্যান্তর সঙ্গেই দেখে করতে এলেন কিনা l সম্পক্কে সে এমন কিছুই না, ওই কোনোরকমে শালার বৌয়ের মৌরী ফুলের জায়ের মেয়ের খুল্লতাত গোছের অথচ সে খ্যান্তর বড়ো প্রাণের মানুষ গো l আহা l সে কোনো দুস্সম্পক্কের তুতো ভাই, কিম্বা কোনো সুজন সখা, কিম্বা কবিতাপাঠের দোসর হলেও বা l সে তোমরা যাই ভেবে নাও গে কেন l কেবলরাম ম্যাজিক জানেন l খ্যান্ত তো যে সে মানবী নন l তেনার চারপাশে সবই মায়া l জাদু না জানলে তাঁর বন্ধু হওয়াই যায় না l তাই কেবলরাম আগের দিন রাতারাতি বেশ কিছু পাটনাই বেসন কা লাড্ডু বানিয়ে ইয়া দু বাক্স লাড্ডু এনে হাজির করেছেন l তাতেই দিব্যি করে ঠেসে দিয়েছেন মনোভরণ জাদুর মসলা l অবশ্যই একখানি মায়াময় বাক্স ধূর্জটি পিসেমশাইয়ের প্রাপ্য l

বলি, অ খ্যান্ত, আজ যে এতো রান্নাবান্নার ঘটা যে l আবার কোন মেহমান আসছেন শুনি?
বলি বাড়িটাকে কি অতিথিশালা বানিয়ে তুলবে?
পিসেমশাইয়ের কালবোশেখী মেঘের গর্জন ফাগুন দিনের বাতাসটাকে ভারী করে তোলে l
খ্যান্ত পিসি ডোন কেয়ার l তিনি তখন বেশ আয়েশ করে শুধু গুড়ের পায়েস চাপিয়েছেন কেবলরামের জন্যে l কেবলরামের মায়াবী মুখটা মনে উঠতেই বুকটা এই পঞ্চাশোর্ধ দ্বিতীয় যৌবনেও কেঁপে ওঠে খ্যান্ত পিসির l খ্যান্ত গুনগুন করে গান ধরেন – কোথা ভবতারা, দুর্গতি হারা … কত দিনে মা তোর করুণা হবে l
এ সব মুড্ ঢের চেনেন ধূর্জটি পিসে l হুম যত্তসব l বলে চটি চটপটিয়ে তিনি কুমড়োর লতায় সজীব সার দিতে যান বারান্দায় l

কেবলরাম আসতেই চুপিচাপি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন খ্যান্ত পিসি l এলেই খানিকটা অদৃশ্য হয়ে থাকবেন l কেবল শুধু গলায় শুনতে পাবে l দেখতে পাবে না l তারপর ধীরে ধীরে প্রকাশ পাবেন খ্যান্ত পিসি l এ’সব অবশ্য পুরোনো খেল কেবলরামের কাছে l আজ এদ্দিন পর দেখা এতো পুরোনো বন্ধুনীর সঙ্গে, অনেক গপ্পো, অনেক ম্যাজিক, অনেক হাসিরাশি বাকি যে এখন l আজ সেই নতুন জাদুটা শেখাতে হবে খ্যান্ত কে l আজ আর দাবার ছকে নয়, পুরো মেন্টাল দাবা খেলবেন দুজনেই l মনে মনে ছাদের দিকে তাকালেই ছক ফুটে উঠবে l খেলা হবে l হবে খেলা l মনে মনেই l উফফফ আর ভাবতে পারেন না গড়গড়ি l ধীরে ধীরে বলেন, খ্যান্ত প্রকাশ হও l আর খ্যান্ত পিসি যেই না ঝলমলিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়েন, অমনি কিনা ব্যাগ থেকে বের করে আনেন দু বাক্স জাদুর নাড়ু l একটা তোমার আর আর একটা ওনার l ভেতরবাড়ির দিকে তর্জনী তোলেন কেবলরাম l

জানি, বলেই এক গাল হেসে, একটা বাক্স নিয়ে উধাও হন খ্যান্ত পিসি l
এই নাও গো, তোমার জন্যে কেবলরাম লাড্ডু এনেছে l
কে? বিটকেল ধরণের মুখ করেন পিসে l কিন্তু কি আশ্চর্য l
লাড্ডুর বাক্স হাতে নিয়েই কেমন হেসে ফেলেন – খিক খিক খিক l
আর একখানা মুখে দিতে তো আর কথাই নেই l আহ্লাদে গলে গিয়ে নরা মরা হরা হয়ে গিয়ে, ঘেঁটে ঘুঁটে একসা l

বলেছিলাম কিনা l কেবলরামের ম্যাজিকের কথা l হুঁ বাবা, এ সব তো যে সে কথা নয় l
এরপর আয়েশ করে চা নিয়ে দুই বন্ধুতে জম্পেশ গল্প গাছা সারাদিন ধরে l
আর ধূর্জটি পিসে ওই নাড়ু খান আর কী কী ভেবে শুনে, হরিমতি কে বগলে পুরে কী কী সব গপ্পো করতে থাকেন, করতেই থাকেন l

আর এরই মধ্যে খ্যান্ত পিসি আর কেবলরাম গড়গড়ি, হাতে হাত ধরে চাঁদে যায়, চাঁদের মাটিতে গড়াগড়ি খায়, হাসে, কাঁদে, নাচে, গায় l খেলা চলে নিরন্তর l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ইচ্ছে ঘর

হয়েছে কি, লাল শেয়ালনির ডেরার পাশে কমলিনীর একটা ইচ্ছে ঘর ছিল l সেই ঘরে কী কী যে ছিল না l জোনাক পোকার দীপ ছিল l মেঘ মেঘ সব দুঃখ ছিল l রাজকন্যা মণিমালার ডাগর চোখের মুক্তো অশ্রু ছিল, রূপকথার কত বই ছিল আর ছিল কমলিনীর সেই মেয়েবেলার রত্নসখার নিরন্তর আসাযাওয়া l ছোটবেলার খেলনাবাটি দিয়ে সাজানো ওদের লালনীল সংসার l কপালের থেকে একগোছা চুল সরিয়ে ঘেমেচুমে বহু পথ পেরিয়ে, মায়ের বকুনিকেও থোড়াই কেয়ার করে সে নিত্য হানা দিতো ঠিক দুপুরবেলায় l কমলিনীও তখন হেতাল গাছের সীমানা পেরিয়ে ইচ্ছেঘরে হাজির l ব্যাস আর পায় কে? ওই ইচ্ছেঘরেই যত হাসিকান্না হীরাপান্নার অবাধ বিচরণ l রত্ন হাতে করে নিয়ে আসে, কেটে যাওয়া ঘুড়ি, ভাঙা কাঁচির আধখানা, চকলেটের বাক্স, ছেঁড়া পুঁতির মালা, একটা আস্ত ব্যাঙাচি, সবই ওই কমলিনীর আজব বাক্সর জন্য l সে ঐসব আজগুবে খেলনাপাতি, জমিয়ে রাখতে ভালোবাসে কিনা l ওই সব হাতে নিয়ে সে অবাক তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে l কখন প্লাস্টিকের চটি চটপটিয়ে, কপালের চুল সরিয়ে, একগাল খরগোশ-হাসি নিয়ে ছেলেটা এসে ঢুকবে l তারপর ওই কাঠকুঠরী দিয়ে জোড়া লাগানো বাড়িটাকেই আবার ঠুকঠাক মেরামত করে কেমন প্রাসাদ বানিয়ে তুলবে কমলিনীর জন্যে l কমলিনী বাড়ি থেকে এনেছে দুটো ডিমসেদ্ধ, সাবি মাসিকেও লুকিয়ে l আজকে দুপুরে ওদের এটুকুই খাওয়াদাওয়া, যদি না রত্ন তার জামার বুকপকেট থেকে বের করে আনে মিইয়ে যাওয়া দুটো বিস্কুট l ঐদিয়েই ইচ্ছে ঘরের ইচ্ছেমতো জলপান সারে ওরা l এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসিখুশির খাওয়াদাওয়া l কমলিনী পড়ে শোনায় ওর নতুন লেখা গপ্পো l কখনো হাঁ করে শুনতে থাকে রত্নর গান l এই সবুজ অবুঝ মুহূর্তগুলো ছোট মানুষ দুটো ভাগ করে নেয় l এর পর মায়ের বকুনি, দিদিমণিদের চোখরাঙানি, এসব তো আছেই l কিন্ত কিচ্ছুক্ষণের জন্যে ইচ্ছেঘরে হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকে দুই বালকবালিকা …. তারপর কোনদিন জীবনের ওঠাপড়ায় ইচ্ছেঘর হারিয়ে যায় কেমন l

———————————————————————————————————————————————————

কমলিনী, ওই …. কোথায় গেলে ?
এই তো আমি l তোমার স্পেশাল চা বসিয়েছি রত্ন l আসি গো ওওওওও …
আজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে কমলিনীর ইচ্ছেঘরে পা রেখেছেন রত্ন l তাই বুঝি কমলিনীর পায়ে পায়ে আজ বনোহরিণী-ব্যস্ততা l
এর মধ্যে অনবরত জল বয়ে গেছে গঙ্গায় l অনেক গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের দরজায় উপনীত আমাদের নায়ক নায়িকা l
আজও রত্ন শান্তিনিকেতনে ঝোলা থেকে বের করে দিয়েছেন কাপড় শুকোতে দেবার ক্লিপ, টেবিলের কোস্টার, রান্নাঘরের সারভিং স্পুন, নুন-মরিচ দানি, এইসব টুকিটাকি l
এই, এইসব যে, তোমার মনে আছে? এখনও ?
রত্ন লাজুক হাসে, কপাল থেকে চুল সরায় সেই ছেলেবেলার মতো l কমলিনীর তাঁর মেয়েবেলার ভালোলাগায় ফিরে যেতে যেতে দেখেন, সেই দুষ্টু মিষ্টি হাসিটা বুঝি একই থেকে গেছে, এতটুকু বদল নেই কোত্থাও l
রত্ন ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে সেই এক চিলতে একখানা বহু-যত্নে-সেজে-ওঠা ইচ্ছে ঘরখানি l
এতদিনে এখানে একটুকু শান্তির ঠিকানা পাওয়া যাবে, শিশুবেলার দুপুরগুলোর মতো l হেমন্তের ডাকপিওনএর চিঠি এসেছে ওঁদের জীবনে l তার চৌকাঠপুরে দাঁড়িয়ে শিশুবেলার ওম পেতে কার না ভালো লাগবে?

কমলিনী ওর লেখা পড়ে শোনাবে আর মুগ্ধ বিস্ময়ে চকোরের মতো থাকিয়ে থাকবেন রত্ন, চন্দ্রমুখীর পানে l ভরা গলায় গান গেয়ে ওঠেন রত্ন … অনাবিল এক আনন্দে l কিছুই কি হারিয়ে যায় নি, কালের গহ্বরে? সব অটুট আছে আজও ?

ঠিক তখনই রত্নকে আরো অবাক করে দিয়ে কমলিনী প্লেটে করেন এনেছেন ডিম্ সেদ্ধ l
আর রত্ন? পকেট হাতড়ে বের করেন বিস্কুট l
বিকেলের আলো এসেছে জানালা বেয়ে l ওই পড়ন্ত রেশমি আলোয়, ঘুম ঘুম ভালোবাসা ছেয়ে রয়েছে সারা ঘরটায় l
কমলিনীর ইচ্ছে হয়ে বেঁচে থাকা মানুষটি আজ ফিরে এসেছেন ওঁদের ইচ্ছে ঘরে l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

মা শেয়ালনি

আজ সক্কাল সক্কাল কমলিনীর মন ভালো নেই l দু’দিন ধরে হুলিবিলি আসে নি l সেই যে ওর কল্পনার বন্ধু, যে ওর পেট ফুঁড়ে বেরোয় আর কেউ আসলেই, পালিয়ে যায় কোন গহীনে l সত্যি বলছি, এই পৃথিবীতে বই আর হুলিবিলি ছাড়া কেউই নেই ওর l ও’দিকে বোনকে নিয়ে মা, বাবা, সাবিমাসির ব্যস্ততার শেষ নেই l বোনের পেটের অসুখ, জ্বর, বায়না আরো কত কী কী l কমলিনী তাই নেই হয়েই থাকে, দেয়াল, দেরাজ, আলমারি, জানালা, দরজা, সব কিছুর সঙ্গে মিশে গিয়ে l তাই দুপুর দুপুর সব্বাই ঘুমোতেই বেরিয়ে পড়ে কমলিনী l ওই দূরে, হেতাল গাছটা একটা বিশাল দস্যুর মতো দাঁড়িয়ে আছে l কিন্তু কমলিনী জানে, ও মোটেই দৈত্য নয় l ভারী মায়াবী আর দয়ালু ওই গাছটা l ওই গাছটাই কমলিনীর সীমানা কিনা, ওকে পেরিয়ে যাওয়া ওর মানা l কারণ ওর ওপারেই লাল শেয়ালনির ডেরা, কালি সাপিনীর গর্ত, বুনোদের এলাকা, বাঘা কুকুরদের ঘরবসত আর কোম্পানির বাগান l সেখানে কুলমণি দাদা আর সাবিনা মাসির গপ্পোগাছার জায়গাটি টমেটো ক্ষেতের আড়ালে l এ’ সব জানে কমলিনী তবু ওই ছায়া ঘেরা, গাছের মায়ায় ভরা ছোট বন জঙ্গলটা বারবার ওকে হাতছানি দেয়, কেন কে জানে l

এইইইইই কমলিনী, আয় আয় আয় l দুপুরের রোদ্দুর ভেজা বাতাস ডাক পাঠায় l শুকনো পাতার মর্মরে সে ডাক ফিরে ফিরে আসে l হায় হায় হায় l ঠিক যেন ওই দয়ালু গাছ, লাল শেয়ালনি, কালী সাপিনী, বুনোরা, বাগানের গাছেরা এক সঙ্গে ডাক দিয়েছে কমলিনীকে l কার তাড়া খেয়ে কমলিনী আনমনে বাগানের দিকে হাঁটতে থাকে ও নিজেই জানে না l ওর মনখারাপ, কারণ আজ ওর সাধের কলমটা গেছে ভেঙে l কালি, দোয়াত সব রয়েছে অথচ কলমটা হাত থেকে পড়েই দু আধখানা l কমলিনীদের মালি দাদা যখন হঠাৎ মারা গেলো, তখনও যেন এই রকমটাই মনে হয়েছে কমলিনীর l মাটি খোঁচানোর খুরপি, শাবল, কুড়ুল, অমন সুন্দর বৌ, সব রইলো পড়ে l আর দ্বিজ মালিদাদা মরেই গেলো l যাই বলো ভেঙে যাওয়া জিনিস আর মরে যাওয়া মানুষদের কাছাকাছি একটা অদ্ভুত সুন্দর দুঃখ শুয়ে থাকে যেন l সে সব দুঃখের আলাদা আলাদা গন্ধ আছে l প্রানছোঁয়া অপূর্ব সব ইস্তাহার আছে l কমলিনীর মন চঞ্চল হয় l হঠাৎ মরে যাওয়া মানুষের কথা মনে পড়ে, ভয় ভয় লাগে যেন l দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি মরে যাওয়া গাছ এধারে l এক একটি গাছ যেন একে অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত l বাজ পড়ে মরে যাওয়া গাছেরা যেন মরা মানুষের মতোই হাত পা বাড়িয়ে ডাকতে থাকে কমলিনীকে l কমলিনী কল্পনা করতে ভালোবাসে l এই ভয়টুকু কল্পনা করেই বড়ো রোমাঞ্চ জাগে ওর l পায়ে লাগায় তাড়া l লিখতে হবে, কিন্তু লিখবে কিসে ? কলম তো ভেঙে গেছে !

ছুটে চলে কমলিনী, সরু, জঙ্গুলে পথ বেয়ে l শেয়ালনির ডেরার পাশেই ওর ছোট্ট ঘর, কোনোমতে “বুড়ির বাড়ির” মতো জোড়াতাড়া দিয়ে তৈরী l যেন অনেকটাই, রেড ইন্ডিয়ানদের ওইগুয়াম l কি নেই তাতে l পুরোনো একটা লেখার চৌকি, হ্যারিকেন, নড়বড়ে বইয়ের সেল্ফ, লেখার কাগজ, প্রিয় বই জেন এয়ার, এ’সব নিয়ে কমলিনীর সংসার l নিজের মতো একখানা লেখার, ভাববার, সময় কাটাবার জায়গা l পা চালিয়ে ভেতরে ঢুকেই চমকে যায় কমলিনী l একী দেখছে ও আজকে? লাল শেয়ালনি গেঁড়ে বসে আছে ওর সাধের ঘরটির মধ্যে l আর ওর পেটের কাছে কুঁই কুঁই করছে ডিমের-কুসুম-রঙা আন্ডাবাচ্চা l কাল বা আজই হয়েছে তারা l তারা এ ওর ঘাড়ের ওপরে চড়ে, জড়িয়ে-মড়িয়ে ভয়ংকর তালগোল পাকিয়ে আছে l কোত্থেকে যে এতো আদর, এতো উজাড় করা ভালোবাসা বর্ষার জলের মতো ধুয়ে দিলো কমলিনীর মনকে … অমনি সব কিছুই, ভীষন ভালোলাগায় ভরে গেলো l ওর মনে হতে লাগলো, এই চারিদিকের সব গাছ, সব পশু, সব প্রাণী, সব মানুষকে ভালোবাসার জন্যেই ও একাই রয়েছে, ওই একফোঁটা মেয়ে কমলিনী l যেন বৃষ্টিশেষের রামধণু রঙ ভালোবাসা সাতটি সুরের রঙে, জলতরঙ্গ বাজিয়ে গেলো ওর মনে l ভাগ্যিস এখানে খাবার জন্যে একটু দুধ আর পাউরুটি এনেছিল কমলিনী l দুধ পাউরুটিতেও শেয়ালনির না নেই l এতদিনে শেয়ালনি ছিল দূরের বন্ধু, আজ এতো কাছে l খুশি হয় কমলিনী… আহা গো l শেয়ালনির ভারী খিদে পেয়েছে l ও খেয়ে দেয়ে পেট জয়ঢাক করে, সোনা মুখ করে ঘুম যায় l

আজ কলম ভাঙার দুঃখে লেখা হলো না ঠিকই l তবে মনটা ভরে ওঠে কমলিনীর l কে বলেছে কিছু ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না ? এই তো কেমন সংসার বেড়েছে ওর, দায়িত্ত্বও l কাল থেকে নিজের খাবার থেকেই লুকিয়ে আনতে হবে ওকেই – শেয়ালনির জন্যে l

বিকেল হতেই যাবার তাড়া থাকে l বাবা মা সাবিমাশি খোঁজ খোঁজ রব তোলার আগেই বাড়ি ফিরবে ও l তাই বাড়ি যাবার পথে, একবার স্মরণ করতেই হুলিবিলি এসে হাজির l সারাটা রাস্তা গপ্পো করতে করতে পথ চলে ওরা l সীমানায় এসে হেতাল গাছকে জড়িয়ে ধরে কমলিনী l ও গাছ, আমাকে তোমার মতো করে দাও না কেন l হুলিবিলি এইখান থেকে বিদায় নেয়, কাল আসবে বলে l আর কমলিনীর মনে হয়, চারিদিকটা কী সুন্দর l গাছ, শেয়ালনি, হুলিবিলি, পাথর, মাটি, রাস্তা, পাগলাঝোরা, ঝিকিমিকি জলের পুকুর, আলোময় বনপথ, সব সুন্দর, সব ওর নিজের l কে বলেছে ও একা? কমলিনী খুশি খুশি বাড়ি ফেরে l

ও লেখে একটু আধটু l বাবা তাই ওকে ওঁর সবুজ শেফার্স কলমখানি দিয়েছেন l আর একটা নতুন ডায়েরী l কমলিনী তাতে মোটা মোটা করে লিখেছে, মা শেয়ালনি, আজ থেকে, তুমি আরো বেশি সুন্দর …

অপর্ণা গাঙ্গুলী

জোনাক-গলি

আমাদের গলিটাকে ঠিক কেন, কোন কারণে যে জোনাকপোকা গলি নাম দিয়েছিলাম, জানি না l তবে, যখন খুব গভীর রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, আমি বই হাতে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতাম, মাথা তুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতাম … দেখতাম আকাশের নীল রেশমি সামিয়ানাটাতে ঝিকমিক জোনাক তারায় ভরা থাকতো l ঠিক তখনই বেশি মন খারাপ হলেই তারাগুলো এক এক করে টুপটুপিয়ে ঝরতে থাকতো নীল হলুদ সবুজ আলোর ফুলকির মতো l তারার আলোয় বই পড়া যায় না, কিন্তু বই আমার বন্ধু মেয়েবেলা থেকেই, তাই বই বুকে করে সারারাত অমনি বসে কাটিয়ে দিতাম l আমার মাথায়, গায়ে, তারার ফুলকি l ওই জোনাকগলি তখন সার্থকনামা হয়ে উঠতো কেমন l সারা রাত ওই জোনাক-গলি একটা মায়াময় ধূসর নীলাভ আলোর চাদরে মোড়া থাকতো l কি অদ্ভুত মায়াবী দেখতে লাগতো চারিপাশটা l গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ ভেসে আসতো চুপিচাপি l ওই তো দূরে দূরে মৌ, বাবলু, মলি, বাপ্পানদের ঘর সারি সারি l জোনাকির ফুল ছড়িয়ে গেছে ওদের ঘরের চালে, বাগানে, গেটের মাথায়, ইতিউতি l স্কুলে দেখা ম্যাজিশিয়ানের জাদু দণ্ড যেন ছুঁয়ে গেছে, সব ঘর বাড়ি, বাগান, পার্ক, জানলার রেলিং, গেটের হাতলখানি l হরিমতি বেড়ালনী ও তার কচিকাঁচাদের নখের মাথায় হীরের ফুলকি l তক্ষকের চোখে, বুনো কাঠবেড়ালির টুকুরমুকুর চলে যাওয়াতে, কালো সাপিনীর নীলচে ডিমে সেই আলো ঘুরে ঘুরে ফিরছে l

সারাদিনে আমার মনের কথা বলার কেউ নেই l বোনের শরীর খারাপ, তাই মা বাপি দুজনেই খুব ব্যস্ত, মায় সাবিমাসিও l এমনিতে খুব যে কথা বলি, তা নয়, তবে ওই আর কি, একলা থাকতে থাকতে থাকতে থাকতে খুব নেই হয়ে আমাতে মিশে থাকতে ভালোবাসি আমি l আমার সাথী বই আর রাতের সঙ্গী এই অদ্ভুত মায়াময়তায় চারিয়ে যাওয়া দশদিশি l সারাদিনের ক্লান্তির পর, মা বাবা ঘুমোতেই আমি টিপিটিপি বেরিয়ে এসে বাগানে বসি l তখন এরা সবাই আমার সঙ্গী l এরা কেউ আমাকে পর করে দেয় না l এদের কাছে আমি নতুন পড়া গপ্পের চরিত্রদের কথা বলি, গপ্পো করি ইনিয়ে বিনিয়ে l শব্দ তখন জোনাক ফুল হয়ে ফোটে l আর সেই সব শব্দ চয়ন করে সযত্নে মখমলি কিংখাবে ঢেকে আমি তুলে রেখে দিই আমার মাথার মধ্যে l আমি ফুলের ফুটে ওঠার শব্দ শুনি l বাতাসে ফুল পাতাদের কথা ভেসে আসে l চুপপপপপপপ্ l এই বিশাল তমিশ্রার ঘনত্বে আমি কী কী যে সব শুনে ফেলি, সে সব কাউকেই বলার নয় l তখন তারাদের কান্না বোঝা যায় l কোনো কোনো ফুল ফুল জোনাক-তারা মনের কথা বলে, কাঁদে l

আমার বন্ধু বিনির মতো ওরা l ওর মা বাবা আলাদা থাকেন, তাই ওর খুব কষ্ট কিনা l বিনি থাকে ওর বুড়ি ঠাক্মার কাছে l আহা আমার মতো বিনিও যদি এই জোনাক-গলির খোঁজ পায় তো বেশ হয় l ভোরের বেলা ঘুমিয়ে গেছি গন্ধরাজ গাছের নিচে l বাবা এসে কোলে করে তুলে নিয়ে যান l এ’সব কিছু নতুন নয় তো l বাবা জানেন, এ’সব না করতে দিলে, আমি হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়েই যাবো l বাবা মাকে কিচ্ছুটি বলেন না কোনোদিন l

আজও জোনাক গলি খুঁজে ফিরি আমি l টুপটুপ করে তারাদের ঝরে পড়া দেখতে চাই l কি জানি, হয়তো মেয়েবেলার সেই অবাক মনটাই হারিয়ে গেছে অমনি l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

ছবি – স্টারি নাইট, ভ্যান গঘ

মধুরম

  • শুভঙ্কর, তুমি হাতে হাত রাখলে অমন করে?
  • বাহ্ রে, নন্দিনী, তোমার তো এসেকেলেটরে ভয়, আমি জানি না বুঝি? সেই সংশয় l আর এই অছিলায় তোমার চন্দনগন্ধ নিলাম হৃদয় ভরে, তার বেলা?
  • এই ছেলে, শুধু চন্দন চন্দন … আর কেয়া, চামেলী, বেলি, জুঁই, এদের বুঝি দিলে ছুটি?
  • ওরে আমার হিংসুটি … ওই যে দিলাম কথার আদর, তোমার মুখে, বুকে, ঠোঁটে? সে সবই বুঝি ধূলি খেলা?
  • না না ঠিক তা নয়, তবে কি জানো? তোমার চোখে দেখেছিলাম, অনেকদিনের আশ্বাস, অনেক বছর পরে l
  • তবে রে, আর তোমার চোখে, দেখি নি বুঝি কিছু? ও মশাই, তারপরে, আর ভাবিই নি তো, আগুপিছু l
  • হাতে হাত আর স্তব্ধ কিছু মৌন প্রতিশ্রুতি l এই তুমি ও’সব বুঝবে না গো, এখানেই টানো ইতি l
  • ইতি মানে, জারুলের নিচে ঠোঁটে ঠোঁট, চোখে চোখ ? অজানা পাখি, ফোড়ন কাটে, গৃহস্থের খোকা হোক l
  • তিনটে চুমু, চারটে তো নয়, ঠোঁটের মাঝখানে l উষ্ণ, ভেজা এসব চুমুর মানে কেই বা জানে ?
  • তুমি আমি ছাড়া নির্জন বীথি, গাছগাছালিরা প্রহরী … হয়ে গেলো বিয়ে, আর কেন ইয়ে, সব ভুলে গেছি, ও হরি l
  • দু’জনের ছায়া মানব মানবী, পাশাপাশি হাঁটা, দেখে বেশ লাগে বলো ?
  • এই নন্দিনী, ওই মেয়ে! তোর চোখে জল উপছল?
  • আসবো আবার বারে বারে ফিরে, রূপনারাণের পথে,
    আউলা বাউল, নীরব দেউল, হাত ধরে থাকো হাতে l
  • আসবো আবারও, ছেড়ো না আমাকে … প্লিজ আরো ধরে থাকো …
  • নন্দিনী, ঠিক চিনে নেবো তোমাকে, আগামী জন্মে, এই বিশ্বাস রেখো l

(নন্দিনী শুভঙ্করের পথ প্রতি দিনের শেষে ভাগ হয়ে যায় দুই দিকে l এক বছরের করোনা আবহ পেরিয়ে তাদের এই পুনর্মিলন আরও অনেক অনেক মিলনের সাক্ষী হয়ে রইলো চায়ের কাপে, ফার্স্ট ফ্লাশের দেয়াল লিখনে, চোখের চাওয়ায়, ভালোবাসার অলিতেগলিতে l ওরা মিলিত হবে বারংবার, আরও অনেক ঝগড়া বিবাদ প্রেম ভালোবাসা সোহাগ আদরের সাক্ষী রেখে l ওদের পথ চলা মধুময় হোক l)

নমঃ মধু ll

চিলেকোঠা

পুরোনো মামাবাড়ির সবচে উঁচুতলার ঘরটাকে আমরা বলতাম চিলেকোঠা l খুব বৃষ্টি নামার আগে অনেক নিচুতে ওড়া চিলটার বুক ছুঁয়ে যেত ঘরের মাথাখানা l আর কখনো কোনো মেঘ-বিকেলে কেমন করে যেন একখানা জলভরা মেঘ ঢুকে আসতো সেই ঘরে l পার্বতী পিসির বিছানা বালিশ ভিজেভুজে উপুড়ঝুপুর l কোনো নিজ্জলা একাদশীর তপ্ত দিনে উপবাসী পার্বতী পিসি আমাদের দিম্মিদের মাছের ‘পরে শ্যেন দৃষ্টি হেনে মরা সোয়ামির বাপান্ত করতে করতে বুঝি বা চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছিলেন l এমন সময়ে কালবৈশাখীর বর্ষা মেঘ তার রাজ্যের অভিমান ধুয়ে মুছে সাফ করতে ঢোকে এসে চিলেকোঠাতে l মরণ আর কি, বিড়বিড়িয়ে মনের আশ মেটান গালিগালাজ করে l আর বিছানার তল থেকে বেরিয়ে আসে পদ্য খাতা l গেলোবছরের পুরোনো খাতাদের অব্যবহৃত পাতা জোগাড় করে নিয়ে কেমন খাতা বেঁধে দিয়েছে ছোটমামা l দাদুর ঝর্ণা কলম দিয়ে গোটা গোটা করে নাম লিখেছেন সেই খাতার ওপরে – শ্রীমতি পার্বতিরানী দাসী l কিন্তু পার্বতী পিসি সেই খাতায় পদ্য লিখবেন কেন? তার যে সবকিছুই বেখেয়ালে, সবটুকুই ভারী অন্যরকম l তাই বুড়িঠাকমার ঘর থেকে কাঠ কয়লা জোগাড় করে সে দেয়াল জুড়ে আঁকে বিয়ের কনে, বধুচক্র, ফুল লতা পাতা, ময়ূর রাজহাঁস হাতি আর দেয়ালে লিখে রাখে ভারী সরল সব অন্ত্যমিল পদ্য l
সেই যে গেলে, আর তো এলেনা l
এসব মিথ্যে, এসব ছলনা ll

আমার বোন পাখি বরাবরের পাকা গিন্নি l চোখ গোলগোল করে আমাকে বুঝিয়েছিল, সে’সব নাকি মরা বরের জন্য লেখা না l বাকিটুকু উহ্য l আমিও কৌতূহল প্রকাশ করিনি, কারণ এ বিষয়ে আগ্রহ হবার বয়স সেটা নয় l তবু সেই কিশোরী বয়েসেই চিলেকোঠার বাইরে থেকে বুঝে যাই, কী যে বিন্দু বিন্দু অভিমান সাজানো আছে ঘরটার প্রতিটি পরতে পরতে l মেঘের মতো সেই সব অভিমান, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার জন্যই কেবল অপেক্ষমান l অপেক্ষা এক দারুন কালবৈশাখীর l

মানবী মনে কোন কারণে কি নিয়ে কখন যে অভিমানটুকু জন্মে যায়, তা হয়তো মেয়েরাই বোঝে, বা বোঝে না l পার্বতী পিসির, লাল শাড়ী পরা কেউ এলে অভিমান হতো, সিঁদুর খেলে মামীরা মুখ সোহাগী-লাল করে ফিরলে, পিসি দোর দিতেন ঘরে, দাদু দিম্মিকে “কমল” বলে ডাকলে, পার্বতী পিসি ভাত খেতেন না পুরো তিনদিন l আর তার সবটুকু রাগ অভিমান আশ্লেষ অবসাদ ঢেলে দেবার জায়গাটুকু ওই এক চিলতে চিলেকোঠা l সে যবে থেকে বালবিধবা পার্বতী পিসি, মানে দাদুর বোন, স্বামী হারিয়ে দাদুর সংসারে এসে হাজির হয়েছিলেন, ওই চিলেকোঠাটুকুই ছিল তার সম্বল l তার বেঁচেবর্তে থাকার ইচ্ছেগৃহটি l ঐখানেই তিনি হেসে, গান গেয়ে, পদ্য লিখে, অভিমান ফলিয়ে সুখে ছিলেন বটে l জোছনায় চিলেকোঠার পাশের ছাদে নাচতেনও পার্বতী পিসি, দুই হাত ছড়িয়ে, ডানার মতো করে l আমরা আড়াল থেকে গুঁড়ি মেরে চুপিচুপি দেখতাম l দেখলেই মনে হতো এই বুঝি পরী হয়ে উড়েই যাবেন l

ভার্জিনিয়া উল্ফ বুঝি এমনই এক ঘরের কথা বলেছেন তাঁর কালজয়ী প্রবন্ধে – এ রুম অফ ওয়ান্স ওন l একটা ঘর আর পর্যাপ্ত টাকা, যা কোনো বিত্তবতী পিসি খুড়ি রেখে দিয়ে যাবে, কোনো লেখিকার জন্যে l ব্যাস আর কিছু চাই না l আমাদের পার্বতী পিসি হয়তো বা কোনো লেখিকা নন, কিন্তু তিনি এক মরমিয়া তো বটেন l পয়সাকড়ির কথা বলতে পারবো না, তবে বাবার বাড়ির ওই এক ছটাক চিলেকোঠার শান্তি তাঁর কাছে সব পাওয়া ছিল l আর সেই চিলেকোঠা টুকুর জন্যেই হয়তো অনেক নারী আজও হাহাকার করে ফেরে l

পরে, অনেক পরে, সেই মামাবাড়ি ভেঙে ফেলে প্রোমোটিংয়ের সময়ে একবার সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম l খুব ইচ্ছে হলো, সব ভেঙে দেবার আগে, একবার ছুটে গিয়ে পার্বতী পিসির চিলে কোঠা খানা ছুঁয়ে দেখি l কোনও এক কাক ভোরে ওই ঘরখানা থেকেই উধাও হয়েছিলেন পিসি l কোথায় গেলেন, কেনই বা, জানা নেই l দাদু বলেছিলেন, মরে বেঁচেছে মেয়েটা l এর কী মানে l আমি তো ভেবেছি, ধবধবে জোছনায় ডানা মেলে উড়ে গেছেন পার্বতী পিসি l

যা হোক, সেই ঘরে এসে দাঁড়াতেই দেখি, তখনও মেঘ ছড়িয়ে আছে ইতি উতি, পার্বতী পিসির ঢেউ খেলানো চুলের মতোই l

অপর্ণা গাঙ্গুলী

“শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে”

শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে একলা ছাদে
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে বাঁশের পাতায়
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে ব্রিজের মাথায়
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে পদ্য খাতায় l

শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে বারান্দাতে
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, মাদুর পাতা
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে প্রিয়ার মনে
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, আসন পাতা l

শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে জোছনা বিধুর
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে প্রিয় সুদূর
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, জমছে পাড়ি
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, ফিরবে ঘরে ?

শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে কাব্য শেষে
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, অন্ত্যমিলে
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে শুধু শুধুই
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে, তবুও এলে ll

শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে ঠোঁটের রেখায়
শুধু শুধু চাঁদ উঠেছে অশ্রুধারে
শুধু শুধু শুধু শুধুই চাঁদ উঠেছে …
সেই তো এলে, কাছে এলে, বছর ঘুরে ll

অপর্ণা গাঙ্গুলী

**প্রিয় কবির লেখা একটি পংক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত l